স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবহেলার গল্প

স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবহেলার গল্প

- বাইশ বছর আগে আপনার স্ত্রী তার আট মাসের দুধের শিশু রেখে আমার সাথে পালিয়ে গিয়েছিল,  আমি আপনার সেই প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী। খুব  স্বার্থপর হয়ে আপনাকে ঠকিয়ে আমি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলাম আর সেদিন থেকে কিন্তু আপনি আপনার শিশু কন্যাকে নিয়ে হয়ে গেলেন অসহায়। এবার চিনতে পারছেন? 


- চোখের চশমা বাম হাত দিয়ে সামান্য নাড়িয়ে শহিদুল ইসলাম সাহেব তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখ দিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু চোখ দুটো আগে দেখতে চায় তাই মুখ বন্ধ চোখ খোলা। 


- লোকটা আবার বললো, আমার নাম মাহাতাবুর রহমান মুহিত, সবাই আমাকে মুহিত নামে ডাকে। আমার স্ত্রী মানে আপনার সাবেক স্ত্রীও আমাকে মুহিত নামে ডাকে। কেমন আছেন ভাইজান?


- আপনি হঠাৎ কেন এসেছেন? আর আমি কেমন আছি সেটা জানার জন্য আপনি নিশ্চয়ই আসেন নাই। তাই আপনার প্রয়োজন বলেন। 


- এত বছর পরেও রাগটা পুষে রেখেছেন, সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বরং তাহলে আসল কথা বলছি। 


- জ্বি বলেন। 


- আপনার একমাত্র মেয়েকে তার মা দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছে, সে খুব অসুস্থ। বেশ কিছুদিন ধরে সে শুধু তার মেয়ে দেখতে চায় তাই বাধ্য হয়ে আমি এসেছি। আমার আসার কোন ইচ্ছে ছিল না কিন্তু...! 


- জনাব মুহিতকে থামিয়ে দিয়ে শহিদুল ইসলাম বললেন, কিন্তু আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন মিলির মা আর বেশিদিন বাঁচবে না। তাই আপনি চাচ্ছেন মৃত্যুর আগে স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে যেন পূরণ করতে পারেন তাই না? 


- জ্বি ভাই। 


শহিদুল ইসলামের একমাত্র মেয়ের নাম মোহনা আক্তার মিলি আর মিলির মায়ের নাম ছিল সাজেদা বেগম। 


- শহিদুল ইসলাম বললেন, আমার ধারণা মিলি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে না। তবু আমি একবার তাকে বলবো, যদি সে যেতে রাজি হয় তাহলে আপত্তি নেই। 


- সে কি তার মায়ের কথা কখনো মনে করে না? 


- দেখুন মুহিত সাহেব, সাজেদা চলে যাবার পর আমি আর আমার মেয়ের জীবন কেটেছে। আমি যখন বেলকনিতে বসে গভীর রাতে সাজেদার জন্য মন করে থাকি তখন মিলি চুপিচুপি সেখানে গিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আবার মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেদিন মিলি ঘুমিয়ে পরে। সেদিন আমি তার রুমে গিয়ে জ্বলন্ত বাতিটা নিভিয়ে আসি, তার বুকের উপর থেকে ছবিটা সরিয়ে রাখি। তারপর যেভাবে শব্দহীন প্রবেশ করি সেভাবেই ফিরে আসি। মিলি তার মাকে মনে মনে অনেক খুঁজে বেড়ায় কিন্তু আমার সামনে প্রকাশ করে না। কারণ তাহলে তো আমি আরো বেশি করে করবো, তাই দুজনের মনে সে ঠিকই আছে কিন্তু কেউ কখনো সেটা প্রকাশ করে দুজনেই একসাথে নিস্তব্ধ হই না। 


- মুহিত সাহেব টেবিলের উপর এক টুকরো কাগজ রেখে বললো, এখানে মোবাইল নাম্বারটা লেখা আছে। যদি মন চায় তাহলে মিলি যেন কল দিয়ে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে। 


- মিলি তার মায়ের কাছে কল করবে কিনা জানি না, তবে আপনি তার মাকে বলে দিবেন যে মিলির বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। মিলি নিজেই একটা ছেলে পছন্দ করেছে এবং তার সাথেই তার বিয়ে হচ্ছে। 


- আপনার মেয়ের জন্য অগ্রীম অভিনন্দন। 


- দোয়া করবেন মিলির জীবন যেন তার মায়ের মতো না হয়, কারণ তার মা একজনকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু মিলির জন্মের পর মিলিকে রেখে সে চলে গেছে তাই মিলির যেন এমন না হয়, দোয়া করবেন। 



ড্রইং রুমে মেহমান এসেছে সেটা মিলি আগেই দেখেছে কিন্তু রুমের মধ্যে বসে সে তার বয়ফ্রেন্ড মানে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার সাথে কথা বলছিল। সচারাচর সজীব (বয়ফ্রেন্ড) এমন সময় কল করে না কিন্তু আজকে হঠাৎ করে দিয়েছে। সজীব একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে তাই এটা তার অফিসে টাইম। 


- হ্যালো মিলি? 


- হ্যাঁ বলো। 


- কি করো? আঙ্কেল কি বাসায় আছে? 


- হ্যাঁ বাবা বাসায় আছেন, কিন্তু কেন? 


- আঙ্কেলের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে তাই আমি একটু পরে আসতেছি তোমাদের কাছে, তুমি আঙ্কেল কে বলে রেখো যে আমি আসবো। 


- নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ের বিষয় তাই না? 


- হ্যাঁ সেরকমই।


- আচ্ছা বাদ দাও, বিয়ের সময় আমি কিন্তু নীল শাড়ি পরবো তাই কেউ যেন লাল শাড়ির জন্য কভু জোরাজোরি না করে। 


- আচ্ছা ঠিক আছে, রাখি? 


- শোনো আরেকটু। 


- বলো, আমি আমার নতুন চাকরির বিগত সাত মাসের বেতনের টাকা সব রেখে দিয়েছি। বাবার কাছে দিলে সে নিতে চায় না তাই ভেবেছি টাকা দিয়ে আমরা বিয়ের পরে হানিমুনে যাবো। 


- আগে বিয়ে হোক তারপর সবকিছু হবে, আমার কাজ করতে হবে। 


- কখন আসবে তুমি? তোমার জন্য তাহলে আমি নুডলস রান্না করে রাখবো। 


- রান্না করতে হবে না মিলি, আমি বেশিক্ষণ সময় নিতে পারবো না তাই জরুরি কথা বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরবো। 


- সেই কথা বলার ফাঁকে খাবে, কোন কথা শুনতে চাই না আমি। 


সজীব বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিল, মিলি দুইবার হ্যালো হ্যালো করে মোবাইল কানের কাছ থেকে হাতে নিয়ে দেখে কল কেটে গেছে। মিলির মনটা খারাপ হয়ে গেল, এভাবে কেউ কল কেটে দেয়? একবার বিয়ে হোক তারপর সবকিছু সুদে আসলে আদায় করতে হবে। বিয়ের পরে কেমন কি করবে সেরকম কিছু বিষয় কল্পনা করে মিলি হেসে দিল। 


ড্রইং রুমে মিলির বাবা শহিদুল ইসলাম সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে আছেন। আজকে হঠাৎ করে পুরনো স্মৃতি জাগ্রত হয়ে বেরিয়ে গেল। জীবনের একটা অংশ অন্ধকার করে দিয়ে প্রদীপ নিয়ে চলে গেছে সাজেদা বেগম। অন্ধকার মহাসমুদ্রে মিলির মতো একটা বেঁচে থাকার অবলম্বন দিয়ে গেছে। যদি মিলিকে সাথে করে নিয়ে যেতো তাহলে আজ তার কোন যায়গা অবস্থান হতো কে জানে? এখন যেমন করে মিলি তার মাকে বহুবছর ধরে দেখতে পারে না তেমনি তখন উল্টো ভাবে মিলি তার বাবা কে দেখতে পারতো না।


- বাবা লোকটা কি চলে গেছে? 


- প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিলির বাবা। " হ্যাঁ চলে গেছে, তিনি যেই কাজে এসেছেন সেটা শেষ হয়ে গেছে তাই আর দেরি করলেন না। "


- তিনি কে বাবা? এর আগে কখনো তোমার কাছে আসতে দেখিনি। 


- হাত বাড়িয়ে মেয়েকে নিজের কাছে বসিয়ে দিল মিলির বাবা, তারপর বললেন, বাইশ বছর আগে তোমার মা তোমাকে আমাকে রেখে যার সাথে চলে গেছেন ইনি সেই লোক। 


- কি..? মিলির দুচোখ ভর্তি বিস্ময় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তবুও বললোঃ- এতবছর পরে আমাদের কাছে কেন এসেছে তিনি? 


- তোমার মা নাকি ভিষণ অসুস্থ তাই তিনি নাকি তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের ধারণা তোমার মা বেশিদিন বাঁচবে না তাই তিনিও এসেছেন যাতে তোমার মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন সেজন্য। 


- মিলি এক মুহূর্ত চুপ হয়ে গেল, কি বলবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না বলে নীরবতা। তারপর চট করে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি বললে বাবা? 


- মিলির বাবা চোখ থেকে চশমা খুলতে খুলতে বললেন, আমি বলেছি যে আমার মেয়ে যদি চায় তাহলে সে গিয়ে দেখা করতে পারবে। আমার পক্ষ থেকে কোন নিষেধ নেই, তাই তোমাকেও একই কথা বলবো, তুমি যেতে পারো। 


- কিন্তু তিনি আমাদের রেখে চলে গেছেন তাই না? তাহলে কেন যাবো সে ডাকলে? 


- দেখ মিলি, পৃথিবীর সকল মানুষ ভুল করে, শুধু সারাজীবনে একটা ভুল বা কোন পাপ করেননি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। কেউ কেউ তার নিজের ভুল বুঝতে পারে আবার কেউ কেউ সেই ভুলের উপর স্থির থাকে। আর অনেকে আছে যারা ভুল বুঝতে পারে কিংবা অনুতপ্ত হয়ে যায় কিন্তু সে ফিরতে পারে না। 


- তাহলে কি আমার যাওয়া উচিৎ বাবা? 


- হ্যাঁ, তোমার মা যেহেতু তোমাকে দেখতে চার, তাই তুমি যাবে। কারণ শেষ মুহূর্তে এসে তিনি যেন বুঝতে পারেন যে তাকে আমরা ক্ষমা করেছি। 


- তুমি এতটা ভালো কেন বাবা? তোমার মতো বাবা পেয়ে আমি সকল কষ্ট ভুলে গেছি জানো? 


- আমি মোটেই ভালো মানুষ নই, তোমার মা কি তাহলে চলে যেতে পারতো? 


- মা কেন চলে গেছে সেই প্রশ্ন আমি মায়ের সঙ্গে করবো, যদি সত্যি সত্যি দেখা হয়ে যায় তাহলে আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো। 


- মিলির বাবা মুহিত সাহেবের রেখে যাওয়া নাম্বার এগিয়ে দিল মিলির কাছে। " এটা তোমার মায়ের মোবাইল নাম্বার, তুমি চাইলে কল দিয়ে কথা বলে নিতে পারো। "


★★


সাজেদা বেগম মাত্র আসরের নামাজ পড়ে উঠে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীর খুব দুর্বল তাই আজকে নামাজ পড়তে একটু দেরি হয়ে গেল তবুও পড়তে পেরেছেন এটাই তৃপ্তি। স্বামী মুহিত গেছে ঢাকা শহরে কিন্তু সেখানে গিয়ে কি হচ্ছে  কিছুই জানা নেই। নিজের অসুস্থতার জন্য তার  মেয়েকে দেখার জন্য সেখানে মুহিতকে সে পাঠিয়ে ভুল করলো নাকি? তারা যদি অপমান করে তাড়িয়ে দেয়? অপমান করলে তো কিছু করা যাবে না কারণ অপমানিত হবার মতো কাজ সে আর মুহিত দুজনেই করেছে। 


হঠাৎ করে মোবাইলে কল এলো, মোবাইল ছিল রুমের মধ্যে তাই রুম থেকে সেই মোবাইল বাহিরে দিয়ে গেল তার ছোট ছেলে  মিরাজ। 


- সাজেদা বেগম রিসিভ করে সালাম দিলেন, সে বললো আসসালামু আলাইকুম। অপরপ্রান্তে কান্না করার গোঙ্গানি শুনতে পাচ্ছেন সাজেদা বেগম কিন্তু কে হতে পারে? তাই আবার বললেন, কে? 


- একটা মেয়ে আবেগপূর্ণ মুখে তখন বললো, মা আমি মিলি। 


- মুহূর্তের মধ্যে শরীরে একটু শিহরিত হয়ে গেল সাজেদা বেগমের। কে? মিলি? 


- হ্যাঁ আমি আমি মিলি, কেমন আছো তুমি? আর এত বছর পরে তোমার সন্তানের কথা মনে হলো? 


- সবসময় মনে পরে, কিন্তু তোমার বাবা আর তুমি কতটুকু ঘৃণা তাই ভেবে কখনো সামনে যাবার সাহস করতে পারি নাই। 


- কেন এমন করলে মা? আমার মুখের দিকে তাকিয়েও কি তুমি থাকতে পারলে না? আর বাবা তোমাকে কত্তো ভালবাসে তবুও কীভাবে তুমি চলে গেলে মা? 


- তোমার করা অনেক অনেক প্রশ্ন আমি শুধু কান দিয়ে শুনে যেতে পারবো কিন্তু উত্তর দিতে পারবো না কারণ উত্তর আমার জানা নেই। তবে মাঝে মাঝে যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি যে ভাগ্য এভাবেই লেখা ছিল। 


- তুমি কেমন আছো মা? বললে না তো। 


- অনেক ভালো আছি, তুমি কেমন আছো? আর  তোমার বাবা কেমন আছেন? 


- আমরা ভালো আছি, তোমার তোমার শূন্যতা আজও অনুভব করি। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে যে প্রকাশ করতে পারি না। আচ্ছা মা, যে আঙ্কেল এসেছিলেন তিনি বললেন তুমি নাকি অসুস্থ। 


- হ্যাঁ শরীর দুর্বল হয়ে গেছে মনে হয় পরপারে চলে যেতে হবে। 


- এমন করে কেন বলো? আমার সাথে দেখা না করেই চলে যাবে? আমি খুব শীঘ্রই তোমার সাথে দেখা করতে আসবো মা। 


- তোমার বাবা কিছু বলবে না? 


- না বাবা যেতে বলেছেন। 


- তাহলে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, আমি অপেক্ষা করে রবো। 


- আমি কালকে অফিসে গিয়েই ছুটির জন্য বড় স্যারের কাছে আবেদন করবো। 


- তুমি চাকরি করো মিলি? এতবড় হয়ে গেছো? 


- বাইশ বছর আগে তুমি যাকে রেখে গেছো সে কি আজও সেভাবেই থাকবে? 


- তাই তো..! আমি তো আমার সেই পিচ্চি মিলির অপেক্ষা করছি, কিন্তু সে আজ কতবড় হয়ে গেছে সেটাই জানা নেই। 


- জানো মা? তোমার আর বাবার একমাত্র একটা ছবি তোলা ছিল না? সেই ছবিটি আমার কাছে থাকে, আর আমি বেশিরভাগ রাতেই সেই ছবি বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরি। সকাল বেলা দেখি যে ছবিটি যথাস্থানে সাজানো রয়েছে, এর মানে কি বুঝতে পারছো? 


- না তো। 


- এর মানে হচ্ছে বাবা রাতের আধারে আমার রুমে এসে তোমার আর তার ছবিটি তুলে নিয়ে যায় এবং যথাস্থানে রেখে দেয়। কি জানি, হয়তো সেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছবির প্রতি। 


- সাজেদা বেগম শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। 


- মিলি বললো, মা আমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। 


- তাই নাকি? ছেলে কি করে? 


- জব করে, আমি পছন্দ করেছি তাই বাবা আর অমত করেননি। আজ পর্যন্ত বাবা আমাকে কভু বকাবকি করে নাই এবং কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখে নাই। 


- তোমার জন্য শুভ কামনা রইলো, তবে বিয়ের সময় আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে উপস্থিত হতে চেষ্টা করবো। বিয়ে কবে? 


- চলতি মাসের মধ্যে হবে কিন্তু তারিখ এখনো ঠিক করা হয়নি। 


মোবাইল কেটে গেল, ব্যালেন্স শেষ। মিলি তার মোবাইল বুকে জড়িয়ে আবারও কেঁদে উঠলো। এতক্ষণ ধরে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিলির বাবা মা-মেয়ের কথোপকথন শুনছিলেন। মেয়েকে কান্না করতে দেখে তিনি রুমের মধ্যে শব্দ করে প্রবেশ করলো। মিলি একবার মুখ তুলে সে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো, বাবা কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বললো। 


- বাবা আমি শুধু একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসবো, আমি জানি তুমি হয়তো মনে মনে ভয় পাচ্ছ যে মায়ের কাছে গেলে তোমাকে ভুলে যেতে পারি। কিন্তু সেটা কখনো নয় বাবা, আমার এই জীবনের সবটুকু জুড়ে শুধু তুমি বাবা। 


শহিদুল ইসলাম সাহেব কিছু একটা বলবেন তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। মিলির বাবা শহিদুল ইসলাম বললেন, " আবার কে এলো? "


- মিলির মনে পরে গেল যে সজীব তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল কিন্তু এতক্ষণ মায়ের বিষয়ের জন্য সেটা মনে ছিল না। এবার সে বললো. বাবা সজীব তোমার সাথে দেখা করতে আসার কথা ছিল হয়তো সে এসেছে। 


- ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি আমি, তুই বরং নাস্তার ব্যবস্থা কর। 


- আগে দেখো সত্যি সত্যি সজীব কি না? 


- আচ্ছা ঠিক আছে। 


★★


ড্রইং রুমে মিলির বাবা শহিদুল ইসলাম ও সজীব বসে আছে দুজনেই। সজীব মনের মধ্যে একটা কথা সাজাচ্ছে বলার জন্য কিন্তু কীভাবে শুরু করা যায় সেটা খুঁজে পাচ্ছে না। সজীব এর জড়তা কাটিয়ে দিতেই শহিদুল ইসলাম বললেনঃ-


- কি খবর সজীব? কেমন আছো? আর তোমার মা-বাবা কি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেছে না করে নাই? 


- আঙ্কেল একটু ছোট্ট সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই সেটা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি। 


- কি হইছে? 


- কীভাবে যে বলবো...! 


- সঙ্কোচ কেন? বলে ফেলো। 


- কথাটা আন্টিকে নিয়ে। 


- মিলির মায়ের বিষয়? 


- জ্বি। 


- আচ্ছা ঠিক আছে বলো। 


- আন্টির সঙ্গে আপনার ঠিক কি ধরনের সমস্যা হয়েছিল? আমি সঠিকটা জানতে চাই, অনেকে অনেক কিছু বলে তাই আপনার কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছি। 


- অনেকে বলতে কারা? তোমার পরিবার? 


- জ্বি আঙ্কেল। 


- তারা কি বিয়ের ব্যাপারে পিছিয়ে যেতে চায়? 


- আসলে আঙ্কেল ব্যাপার হচ্ছে...! 


- ব্যাপার বুঝতে পারছি আমি, মিলির মা ওকে রেখে অন্য কারো সাথে চলে গেছে এটা সত্যি। এবং সে বিষয় জেনে যদি তোমার পরিবার বিয়ে করাতে না চায় সেটা ভিন্ন কথা। 


- আমার মা-বাবা এই সমস্যাটা একটা বড় করে নিচ্ছেন তাই আরকি। 


- তুমি প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে দেখা করছো সেই দিন কি বলছো মনে আছে? 


- জ্বি আঙ্কেল। আমি বলেছিল যে যেকোনো কিছু হোক তবুও মিলিকে চাই। 


- এখন কি মতামত পরিবর্তন হচ্ছে? 


- আপাতত কিছুদিন পিছিয়ে দিচ্ছি, আমি আমার মা-বাবাকে বলে বোঝাতে চেষ্টা করবো। 


- আমার কেন যেন মনে হচ্ছে যে তুমিও হয়তো আমার মিলিকে বিয়ে করতে চাও না। সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে সরাসরি বলে দিও কারণ আমি চাই না আমার মেয়ে একটা মিথ্যে স্বপ্ন দেখুক। 


- আমি আজ আসি আঙ্কেল। 


- বসো, মিলি নাস্তা নিয়ে আসবে নাস্তা করে তবে যেও সমস্যা নেই। 


- আমার একটু কাজ আছে জরুরি, আমি মিলির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে নেবো। 



নাস্তা নিয়ে ড্রইং রুমে এসে মিলি দেখলো যে তার বাবা একা একা বসে আছে। সজীব কখন চলে গেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না তাই নাস্তা সামনে রেখে জিজ্ঞেস করলো, 


- বাবা সজীব কি চলে গেছে? 


- শহিদুল ইসলাম চমকে গেলেন, তার মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় লেগে গেল। যেই মেয়ে সর্বদা কষ্ট করতে করতে এসেছে, আজও সে আরেকটা কষ্টে পরতে যাচ্ছে। একদিকে এতদিন পরে তার মা ফিরে পেয়েছে কিন্তু সে মুমূর্ষু। আরেকদিকে সজীব এর সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে সেই বেদনা। তিনি ভাবতে লাগলো কীভাবে বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে সেই খবর তার মেয়েকে বলবে? 


ময়না পাখির কথাগুলো। 

পর্বঃ- ০১ 

মোঃ সাইফুল ইসলাম 


ময়না পাখির কথাগুলো। 

পর্বঃ- ০২+০৩

সাইফুল ইসলাম (সজীব)


- শহিদুল ইসলাম বললেন, হ্যাঁ চলে গেছে। সজীব এর নাকি জরুরি কাজ আছে তাই চলে গেল তুমি মন খারাপ করিওনা। 


- কি যেন জরুরি কথা বলার জন্য তোমার কাছে এসেছে মনে হয়, কি কথা বাবা? 


- শহিদুল ইসলাম এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি মিথ্যা বলবেন নাকি সত্যি বলবেন? কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের উপস্থিত বুদ্ধি অনেক ভালো কিন্তু সে গুণাবলি তার নেই। তবুও তিনি সামান্য সত্যি আর সামান্য মিথ্যা মিশ্রিত করে বললেন, আমার মনে হয় সজীবের সঙ্গে তার মা-বাবার হালকা ঝামেলা হয়েছে। 


- কিরকম ঝামেলা বাবা? 


- সজীব বললো যে তোমার মায়ের বিষয়টা নিয়ে তার মা-বাবার সমস্যা আছে তাই তারা হয়তো তোমাকে তাদের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায় না। তবে সজীব তাদের ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, আশা করি সফল হবে। 


- মুহূর্তের মধ্যে মিলির মুখটা কালো হয়ে গেল, সে এখন কি প্রশ্ন করবে সেটা সাজাতে কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর বললো, সমস্যা নেই বাবা, যদি ওর পরিবার মেনে না নেয় তাহলে জোর করার কিছু নেই। তারা যদি আমার সেই ছোটবেলার অপ্রিয় অতীত নিয়ে ঝামেলা করতে চায় তবে সেখানে জোর করে সংসার করতে চাই না। 


- শহিদুল ইসলাম নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলেন, কথাটা তুমি ভেবে তারপর বলছো? নাকি কোনরকম ভাবনা ছাড়া? 


- আমি ভেবে বলছি বাবা, হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি সজীবকে ভালবাসি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি তাদের পরিবারের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করতে জোর করবো। 


শহিদুল ইসলাম লক্ষ্য করে দেখলেন যে মিলির চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। চোখের পানি মনে হয় টলমল করছে কিন্তু মিলি সেটা আটকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এর কিছুক্ষণ আগে মিলি তার মায়ের জন্য কান্না করেছে কিন্তু তখন লজ্জা করে নাই। তবে এখন যদি সজীব এর জন্য কান্না করে তাহলে সে লজ্জা পাবে বলে হয়তো চোখের পানি ফেরাতে চায়। 


- শহিদুল ইসলাম বললেন, একটা কথা বলতে চাই মিলি, বলবো? 


- হ্যাঁ বাবা বলো। 


- তুমি বরং তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চলে যাও, আমার মনে হচ্ছে তাহলে হয়তো তোমার এ মানসিক চাপ কিছুটা কমবে। পুরাতন কষ্ট মুছে যাবার জন্য নতুন মন খারাপ ভুলে থাকার চেষ্টা করতে পারবে। চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে তারপর গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসো। 


- কিন্তু বাবা তুমি একা একা থাকবে? 


- সমস্যা নেই, চিরদিনের জন্য তো আর যাচ্ছ না তাই না? গিয়ে আবার তো ফিরে আসবে। 


- হ্যাঁ বাবা তবুও সে দুচারদিন কীভাবে রবে? 


- তোমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে প্রায় তাই দু দিন পরে এমনিতেই আমাকে একা করে চলে যেতে হবে। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তো বাকিটা জীবন এভাবেই একা একা কাটাতে হবে। 


 কথাটা হয় এক বাক্যে শেষ হয়ে গেছে কিন্তু এর গভীরতা অনেক হয়ে গেছে। বাবা মেয়ে দুজনেই এর অর্থ জানে, দুজনের মনের মধ্যে একটা টুপ করে শব্দের কষ্ট হলো। 


- মিলি বললো, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না বাবা। আমি তাহলে আর বিয়ে করতে চাই না, যেহেতু সজীব এর মা-বাবা ঝামেলা মনে করে আর আমারও তো তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না বাবা। 


- শহিদুল ইসলাম একটু হাসলেন। তারপর সেই হাসি মিশ্রিত মুখে বললেন, সেটা হয়না মিলি আমি আর কতদিন থাকবো? সুন্দর একটা সংসার হবে তোমার, অনেকদিন পরে আমার নাতনিদের নিয়ে বেড়াতে আসবে। কত আনন্দ হবে। আচ্ছা খুব ঠান্ডা লেগেছে মনে হয় তুমি বরং আমার একটা চাদর এনে দাও মা। 


----


রাত দশটার দিকে মিলি সজীব এর নাম্বারে কল দিল, এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল যে সজীব নিজে হয়তো কল দেবে। কিন্তু যখন কল দিল না তখন মিলি নিজেই দিয়েছে। 


- হ্যালো মিলি? 


- আমাদের বাসায় এসে আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেলে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অর্ধেক শেষ হয়ে গেল তবুও আমাকে স্মরণ করলে না। তাহলে কি বাবা আমাকে সম্পুর্ন সত্যি কথা বলে নাই? 


- কি বলেছে তোমার বাবা? 


- বাবা বলছেন যে আমার মায়ের বিষয় নিয়ে নাকি তোমার পরিবার কিছু মানতে চায় না। কিন্তু তুমি নাকি সবকিছু সামলে নিতে চেষ্টা করছো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমিও মনে হয় বিয়ে করে নিতে চাওনা আমাকে। 


- ব্যাপার টা সেরকম নয় মিলি, আমি একটু বিজি তাই তোমাকে কল দিতে পারি নাই। ফ্রী হয়ে ঠিকই কল দিয়ে কথা বলতাম তোমার সাথে। 


- কেন বারবার ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে পার হয়ে যেতে চাও? ভালবাসার কাছে কিন্তু ব্যস্ততার কোন অজুহাত চলে না। সত্যি সত্যি ভালবাসলে কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যে সময় বের করতে হয়। 


- সম্পর্কের এতদিন পরে তুমি আমাকে ভালবাসা শিক্ষা দিচ্ছ মিলি? 


- শিক্ষা নয় সজীব, তোমার যা ভালো লাগে তাই করো সমস্যা নেই। আমি খুব তাড়াতাড়ি মনে হয় মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। 


- তোমার মায়ের সন্ধান পাওয়া গেছে নাকি? 


- হ্যাঁ পাওয়া গেছে। 


- কিন্তু কেন যাবে তুমি? 


- কেন যাব না শুনি? 


- যাওয়া উচিৎ নয় তাই। 


- সেটা আমার বিবেচনা সজীব। 


- এসব কারণে কিন্তু আমাদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে মিলি। 


- যেখানে তোমার মনের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আগেই সেখানে নতুন করে কি হবে? তুমি তো আর এই সম্পর্ক চাওনা সজীব, আর এই বিয়ের জন্য তোমার আগ্রহ ছিল কম। 


- তোমার সঙ্গে কথা বললে খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ইদানীং। 


- ঠিক আছে আর কখনো কল দিয়ে বিরক্ত করব না সজীব, ভালো থেকো সবসময়। 


খুব মন বিষন্ন ভগ্নহৃদয় নিয়ে কল কেটে দিয়ে মিলি কিছুক্ষণ গুমরে কাঁদল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে চোখের পানি মুছে মনে মনে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য ঠিক করলো। তার বাবা যেহেতু নিজেই পরামর্শ দিয়েছে তখন ঠিকই তার যেতে সমস্যা নেই। 


রাত অনেক গভীর হয়ে গেছে নাহলে মায়ের সঙ্গে কল দিয়ে কথা বলতাে মিলি। আর ঠিকানা জানা খুব জরুরি কারণ তাকে তো ঠিকানা অনুযায়ী যেতে হবে। আগামীকাল কল দিয়ে জেনে নিতে হবে মা কোথায় থাকে? 


------


সকাল সকাল মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে মোঃ সাইফুল ইসলামের। তার জীবনের যতগুলো বিরক্তিকর বস্তু আছে তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া। প্রতিদিন ঠিক যখন তার ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই সে প্রাণপণে শপথ করে যে আগামীকাল রাতে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমাবে। কিন্তু সে সেটা পারে না কারণ রাতের বেলা তার মনে থাকে না। মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ দিন সে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়। 


কল করেছে গ্রামের বাড়ি থেকে সাইফুলের দাদা মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদার। গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য বারবার বলে যাচ্ছেন কিন্তু সাইফুল কেমন যেন সময় করে উঠতে পারে না। কিংবা সে গ্রামের জন্য বেশি টান অনুভব করে না তাই হয়ত যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এবার মোতাহার হোসেন তালুকদার খুব শক্ত করে ধরেছেন তাই যেভাবেই হোক যেতে হবে সাইফুল কে। 


সাইফুল নিজেও ঠিক করেছে এবার তাহলে গ্রাম থেকে ঘুরে আসা যাক। ক্লাস এইটে পড়ার সময় সে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকা এসেছে, এরপর একটানা ৬ বছর পরে একবার গেছিল। তারপর আর কোন দিন যাওয়া হয়ে উঠে নাই, তবে তার মা-বাবা যায় মাঝে মাঝে। 


- ঘুম ঘুম চোখে সাইফুল বললো, এত্তো সকাল বেলা কেউ কল দেয় বুড়ো? 


- সে কিরে? এখন আটটা বাজে আর তুই বলো যে এতো সকাল বেলা তাই না? 


- কেন কল দিছো তাই বলো তাড়াতাড়ি। 


- গ্রামের বাড়ি আসবি কবে? 


- এ সপ্তাহের মধ্যে আসবো। 


- সত্যি সত্যি? 


- হ্যাঁ সত্যি বলছি, আমি চাকরি পরিবর্তন করবো আর নতুন চাকরিতে যোগ দিতে ১০/১২ দিন লেট হবে তাই যাবো গ্রামের বাড়িতে। 


- বাহহ খুব ভালো কথা, আমার তো নাচতে ইচ্ছে করছে দাদাভাই, লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স। 


- বেশি নাচানাচি করিও না বুড়ো, পরে গিয়ে যদি হাড়গোড় ভেঙ্গে যায় তাহলে কিন্তু সমস্যা। তোমার বউ কিন্তু বুড়ী হয়ে গেছে তাই সেবাযত্ন করার তো কেউ নাই। 


- কে বলেছে কেউ নাই? আমার ছোটবউ আছে, সে সেবা করবে। 


- মানে কি? 


- তোর একমাত্র ফুপুর মেয়ে ফারিয়া, তোর হচ্ছে ফুপাতো বোন, সে এসেছে তিনদিন হলো। 


- ওর চেহারা আমার মনে নেই, সেই পিচ্চি ছিল তখন দেখেছিলাম মনে হয়। 


- এখন আর পিচ্চি নেই। 


- আচ্ছা তুমি রাখো আমি ঘুমাবো। 


- তাহলে কবে রওনা দিবি? 


- কাল নাহলে পরশু। 


- আচ্ছা ঠিক আছে অপেক্ষায় রইলাম, তোর জন্য পুকুর ভর্তি মাছ আছে রে দাদাভাই। আর এখন তো শীতের দিন তাই গ্রামের মজাই আলাদা তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।


.

.


একদিন পরেই সাইফুল গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল একা একা। ছোটবোন মাহি তার সাথে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সাইফুল তাকে নেবে না। মাহি তো অনেক জেদ করে বসে আছে কিন্তু সাইফুল তার সিদ্ধান্তে অটল। তাই সাইফুলের রওনা দেবার সময় দরজা বন্ধ করে বসে ছিল মাহি। 


বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মধ্যে তার দাদাবাড়ি। বাসা সরাসরি মোড়েলগঞ্জ বাস স্টেশন সোলমবাড়িয়া পর্যন্ত যায়। সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সকাল নয়টা বাজে সাইফুল বাসে উঠে বসলো। বাস ছাড়লো ৯ঃ১৫ মিনিটে। 


মাওয়া ফেরিঘাটে এসে সাইফুল অবাক হবার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। অসংখ্য গাড়ি দাড়িয়ে আছে নদী পার হবার জন্য কিন্তু ফেরি চলাচল বন্ধ কারণ সকাল এগারোটা বাজে এখন নদীর কুয়াশা কমেনি। কুয়াশার জন্য ফেরির চালক তার নির্দিষ্ট ম্যাপ অনুযায়ী চালাতে পারে না কারণ এই পদ্মা নদীর চারিদিকে চর জেগে আছে। তাই এই নদীতে একটু ভুল হলেই ফেরি চরে আটকে যাবে। 


বাস থেকে নেমে সাইফুল একটু হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো কারণ ফেরি চলাচল বন্ধ। হাঁটতে হাঁটতে সে নদীর তীরে গেল এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। গাড়িগুলো সবার আগে ফেরিতে উঠতে পারবে, ইসস তার গাড়িটা যদি এখানে থাকতো তাহলে কত ভালো হতো। জিজ্ঞেস করে জানলো যে এরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে গতকাল রাত দশটার দিকে। তখন থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ কিন্তু এখনো চালু হচ্ছে না। 


বেলা সাড়ে বারোটার দিকে কুয়াশা ভেদ করে ফেরি চলাচল আরম্ভ হলো। নদী পার হয়ে ওপাড়ে উঠতে সাইফুলদের প্রায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। অথচ এমন সময় তার প্রায় গ্রামের কাছাকাছি থাকার কথা ছিল। 


সে যখন মোড়েলগঞ্জ নামলো তখন সাড়ে নয়টা বেজে গেছে, গ্রামের বাস স্টেশন তার মধ্যে তো আবার শীতকাল। শীতকালে মফস্বল শহর কিংবা গ্রামের বাড়িতে এশার নামাজের আগেই সবকিছু নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দেয়। স্টেশনে তেমন কোন দোকান খোলা নেই আর গাড়ি তো নেই বললেই চলে। সাইফুলের দাদা তালুকদার নিজে গাড়ি পাঠিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারে নাই। 


বহুকষ্টে একটা মোটরসাইকেল পাওয়া গেল তাতে করে রওনা দিল সে। ঢাকা শহরে পাঠাও এপসের মাধ্যমে যেমন যাত্রী সেবা চলছে ঠিক তেমনি করে মোটরসাইকেলে করে এই মোড়েলগঞ্জে যাত্রী সেবা চলছে। 


মিনিট পনের পরে হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল, তারপর ড্রাইভার জানালো যে তিনি আর যেতে পারবেন না তাই হেঁটে যেতে হবে। সাইফুল তখন অবাক হয়ে গেছে কারণ সে এতরাতে কীভাবে যাবে? কিন্তু সেই ড্রাইভার লোকটা হঠাৎ কেমন করে যেন এক অদ্ভুত উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করেছে। 


ড্রাইভার বললো, " ভাই আরেকটু সামনে গিয়ে একটা শ্মশান আছে তাই সেদিকে যাবো না। এই এলাকায় এত রাতে স্থানীয় মানুষজন চলাচল করে কম। আমি গেলাম ভাই। "


লোকটা মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে গেল আর সাইফুল কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। এরপর পকেট থেকে মোবাইল বের করলো, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে গান চালিয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকা। তবে তার আগে দাদার সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে হবে। 


হঠাৎ করে কিছু একটা শব্দ হতে সাইফুল তার সামনে মোবাইলের বাতি ধরলো। বাতির সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং সে ভয়ে খুব জড়োসড়ো হয়ে গেছে। 


- মেয়েটা বললো, প্লিজ হেল্প মি। 


- সাইফুল বললো, কে আপনি? 


- আমার নাম মিলি, আমি ঢাকা থেকে এসেছি আর আমার মায়ের কাছে যাবো। কিন্তু এই পর্যন্ত গাড়ি এসে আমাকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা সাদা কিছু একটা দেখে অন্ধকারে দৌড় দিলাম। দৌড় দিতে গিয়ে হাতের মোবাইল পরে গেছে সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। 


- সাইফুল কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মিলি আবার বললো, ওমা আপনার পিছনে আবার সেই সাদা সাদা তিনটা কি? 


পর্বঃ- ০৩ 


সাইফুল শুধু মাথা না ঘুরিয়ে সম্পুর্ন শরীর ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি কেউ মনে হয় দাঁড়িয়ে আছে। সাইফুল কখনো এসব ভূত প্রেত বিশ্বাস করে না তাই সাহস একটু বেশি হচ্ছে মনের মধ্যে। কিন্তু সাথে একটা মেয়ে আছে তাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। 


মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে সাইফুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অপরিচিত সাদা বস্তুর দিকে লক্ষ্য করে বললোঃ- 


- আমি জানি আপনারা মানুষ তাই আপনাদের মূল উদ্দেশ্য জানতে পারলে ভালো হতো। কারণ আমরা শহর থেকে এসেছি আপনাদের সঙ্গে বেশি সময় নষ্ট করতে চাই না। তবে সাবধান করে দিচ্ছি যে খারাপ মতলব যদি থাকে তাহলে পরিত্যাগ করে স্থানান্তর হয়ে যান। 


- এবার সাইফুল এবং মিলি দুজনেই অবাক হয়ে গেল কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাকের মধ্যে থেকে তিনটা মানুষ বেরিয়ে এলো। তিনজন মিলে তখন বললোঃ- সঙ্গে যা কিছু আছে সেটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। 


- সাইফুল বললো, এই ব্যাপার? এভাবে ভিক্ষা করার জন্য এমন শীতের রাতে বসে আছেন? বাহ্ লজ্জা করে না? 


- একজন বললো, লজ্জা যদি না থাকতো তাহলে তো দিনের বেলা করতাম। কিন্তু লজ্জা আছে বলে তো রাতের আধারে ছিনতাই করি, এখন হিরো সাহেব সবকিছু দিয়ে দেন। এ কথা বলে তাদের মধ্যে একজন একটা গ্রাম্য ব্যবহৃত ভারি কিছু একটা বের করলো। 


সাইফুল দেখলো যে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই, আবার এত সহজে হার মানতে মন চায় না। কিছু একটা করার দরকার কিন্তু এই মুহূর্তে কোন বুদ্ধি খুঁজে বের হচ্ছে না। 


এমন সময় একটা কান্ড ঘটলো। রাস্তার কুয়াশা ভেদ করে জ্বলন্ত বাতি জ্বালিয়ে একটা গাড়ি আসতে দেখা যাচ্ছে। ওর দুজন দ্রুত রাস্তার ঠিক মাঝখানে উঠে গেল আর গাড়ি ঠিক এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। সাইফুল পিছনে তাকিয়ে দেখে লোকগুলো অনায়াসে চলে গেছে। হঠাৎ করে গাড়ির মধ্যে থেকে কে যেন বললোঃ-


- তালুকদারের নাতি সাইফুল আছেন এখানে? 


- সাইফুল বললো, হ্যা আমি। 


- তাড়াতাড়ি গাড়িতে আসুন, আপনার দাদাজান চিন্তিত হয়ে গেছে আপনার জন্য আর আপনি তার কল রিসিভ করেন না কেন? 


সাইফুলের হঠাৎ করে মনে হলো যে সে বাটন মোবাইল দিয়ে সবসময় কথা বলতো। তার দাদার কাছে বাটন মোবাইলে ব্যবহৃত সিমের নাম্বার আছে কিন্তু সেই বাটন মোবাইল সাইলেন্ট করে ব্যাগের ভেতর রেখেছে সে।  


- মিলির দিকে তাকিয়ে বললোঃ- আপনি কোন যায়গা যাবেন? যদি অসুবিধা না হয় তাহলে তো আমার সঙ্গে যেতে পারেন, আপনার গন্তব্য যদি বলেন তবে পৌছে দেবো। 


- মিলি গ্রামের নাম বললো। সেই গ্রামের নাম শুনে গাড়ির মধ্যে থেকে একজন বললো, সেটা তো আমরা যেখানে যাবো সেখান থেকে আরো তিনটা গ্রাম পরে। আর মাঝখানে একটা ছোট্ট খাল আছে সেটা পার হতে হবে। কিন্তু সেই খালের উপর কাঠেরপুল ছিল সেটা ভেঙ্গে গেছে। 


- সাইফুল বললো, আপনার যদি সমস্যা না হয় তাহলে আমার সাথে চলেন। কারণ যায়গাটা বেশি ভালো মনে হচ্ছে না তাই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ভালো হবে। 


 মিলি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, তার মোবাইল হারিয়ে গেছে একটু আগে। এখানেই পরেছে কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে, সেটা হয়তো বেশি সমস্যা নয়। কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে কারণ আজকে বিকেল থেকে তার মা বারবার কল দিচ্ছিল তাকে। সকাল বেলা মিলি যখন ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছে তখনই সে জেনেছে যে তার মায়ের শরীরটা ভালো না। বিকেল থেকে তার মা শুধু বারবার তার পথের কথা জিজ্ঞেস করেছে। মিলি বলেছিল বাসস্ট্যান্ডে কেউ একজন যেন অপেক্ষা করে তার জন্য কিন্তু কেউ আসে নাই। মায়ের অবস্থা এখন কেমন সেটা সে জানে না, তবে বারবার শুধু মনে হচ্ছে " দেখা হবে তো? "


- সাইফুলের ডাকে ভাবনা ভেঙ্গে গেল মিলির। সে তাকিয়ে দেখে সাইফুল নিজেও গাড়ির মধ্যে উঠে তার জন্য অপেক্ষা করছে। মিলি বললো, আমার মোবাইলটা যদি একটু খুঁজে পেতাম। 


সাইফুল আবার গাড়ি থেকে নামলো, যারা গাড়ি নিয়ে এসেছে তাদের কাছে বড় টর্চ ছিল সেখান থেকে আলো জ্বলে উঠেছে। দশ মিনিটের মধ্যে মোবাইল পাওয়া গেছে কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসপ্লে খানিকটা ভেঙ্গে গেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে মোবাইলটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। ভাঙ্গা মোবাইল হাতে নিয়ে মিলি সাইফুলের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলো।


মিনিট পাঁচেক সবাই নীরব ছিল, শীতের রাতে গাড়িতে হুহু করে বাতাস বইছে। শরীর কম্পন বয়ে যায় তবুও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। 


- সাইফুল নীরবতা ভেঙ্গে বললো, এদিকে কোন যায়গা শ্মশান আছে নাকি? 


- যিনি এতক্ষন ওদের সাথে কথা বলেছেন তিনি বললেন, তারমানে আপনার দাদার ধারণা ঠিকই আছে। তিনি ভেবেছিলেন আপনি নিশ্চয়ই এই সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে গেছেন। 


- মানে? 


- মানে হচ্ছে খুব সহজ, এদিকে একটা শ্মশান আছে ঠিকই কিন্তু সেটা বহু প্রাচীন। আমাদের এই এলাকার কিছু খারাপ চক্র আছে তারা বাসস্ট্যান্ড থেকে যেসকল যাত্রী রাতের বেলা গাড়ি পায়না, তাদের কে এদিকে নিয়ে আসে। তারপর যাকে যেমন পারে সেভাবেই শ্মশানের ভয় দেখিয়ে রেখে চলে যায়। আর তাদের কিছু লোকজন থাকে তারা যেকোনো সময় যেকোনো উপায়ে ওই মানুষের কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে তারা সবসময় নতুন মানুষ বা দুর গ্রামের মানুষ বেশি টার্গেট করে। 


- আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। 


মিলি চুপচাপ তাদের কথোপকথন শুনে যাচ্ছে তাই কিছু বলার দরকার হলো না। 


----- 


সাইফুলের দাদাবাড়ির সামনে যখন গাড়ি এসে থামলো তখন সবাই এক এক করে নামলো। কিন্তু মিলিও যখন নেমে যাচ্ছিল তখন সাইফুল বললো,  


- আপনি কি এখন যেতে চান? 


- গাড়ির একজন বললো, কীভাবে যাবে? খালের সেই পুল ভাঙ্গা তাই দিনের বেলা সেখান থেকে ছোট্ট নৌকা করে পার হতে হবে। শীতের কনকনে ঠান্ডার মধ্যে তো এতরাতে মাঝি বসে নেই। 


- মিলি বললো, যদি আপনাদের অসুবিধা নাহয় তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। আপনি মনে হয় আমার মতো নতুন এসেছেন, তবে এই এলাকায় আপনার গুরুত্ব আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। 


- আমার কথা ভিন্ন, এটা আমার দাদার বাড়ি তাই এখানে আমার কদর বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। 


- তাহলে আমি নাহয় আপনার সাথে আপনার দাদা বাড়ি যাবো, সকাল বেলা আমাকে পথটা চিনিয়ে দিলেই হবে। 


- ঠিক আছে চলুন। 


সাইফুলের দাদা বাড়ির পরিবেশ আর সকলের এক প্রকার আনন্দ আগ্রহ দেখে মিলি অবাক হয়ে গেল। সবাই কেমন যেন আগ্রহ নিয়ে ছোটাছুটি করছে অথচ তাকে কেউ চেনে না। বাড়ির মধ্যে মানুষ কমপক্ষে ৮/১০ জন হবে কিন্তু সঠিক তথ্য মিলির কাছে নেই। মিলি তার বাবার নাম্বারে কল দিল সাইফুলের মোবাইল থেকে এবং পথের যেই বিপদ সেটা সংক্ষিপ্ত আকারে বললো। সকাল বেলা সে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে সেটাও জানিয়ে দিল। 


সকাল বেলা মিলির ঘুম ভেঙ্গেছে আটটার দিকে। শীতের সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরি হবে এটা নতুন কিছু নয় তাছাড়া মিলি গতকাল সারাদির জার্নি করে এসেছে। 


নাস্তা করতে গিয়েও সাইফুলের সঙ্গে তার দেখা হলো না, মনে হয় এখনো ঘুম থেকে উঠে নাই বা অনেক আগে উঠে গ্রাম দেখতে গেছে। শেষের কথা ভেবে তার লজ্জা লেগে গেল কারণ সে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে।


,

,


সাইফুলের সঙ্গে যখন দেখা হলো তখন মিলি বললো, "আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাবো। যদি একটু ব্যবস্থা করতেন খুব উপকার হবে।" 


- হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, আমি এক্ষুণি ব্যাবস্থা করবো। 


কিছুক্ষণ পরে সাইফুল একটা লোক নিয়ে এসে হাজির হলো। তার কণ্ঠ শুনে মিলি বুঝতে পেরেছে ইনি গতকাল রাতের কেউ নয়। 


- লোকটা বললো, কার বাড়ি যাবেন? 


- গ্রামের নাম সানাইপাড়া, সেই গ্রামের মাহাতাবুর রহমান মুহিত সাহেবের বাড়িতে যাবো। তিনি খুব সম্ভবত একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। 


- লোকটা কিছু একটা বলবে তার আগেই হঠাৎ করে গতকাল রাতের গাড়িতে থাকা একজন এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এসেই মিলির দিকে তাকিয়ে বললো " আপনি মুহিত সাহেবের বাসায় যাবেন তাই না? "


- মিলি বললো, জ্বি। 


- তার স্ত্রীর নাম কি সাজেদা বেগম? 


- হ্যাঁ হ্যাঁ। 


- সেই গ্রামে আমার এক আত্মীয় আছে তার কাছে শুনলাম মুহিত সাহেবের স্ত্রী মারা গেছে আজ ভোরবেলায়। তখন হঠাৎ করে আমার মনে পরে গেল আপনার কথা, তারপর নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম যে সাজেদা বেগম নাকি মারা গেছে। 


- মিলির মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সে শুধু তার মুখ থেকে একবার অস্ফুটে বললো, কি বললেন? আমার মা মারা গেছে? 


সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফুল লক্ষ্য করে দেখলো মিলি টলমল করছে। মনে হচ্ছে একটু পরেই মিলি দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে পরে যাবে। 


ময়না পাখির কথাগুলো। 

পর্বঃ- ০৪ (শেষ) 


মিলির যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন আসরের নামাজ হয়তো মসজিদে শেষ হয়ে গেছে। কারণ মসজিদ থেকে জামায়াতে নামাজ আদায় করে তালুকদার সাহেব মাত্র বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। সাইফুল তখন গেইটে দাঁড়িয়ে ছিল, তার কানে মোবাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কথা বলছিল কারো সাথে।


- মিলির জ্ঞান ফিরেছে তাই সাইফুল তাড়াতাড়ি করে তার কাছে গেল। প্রথমে কীভাবে কথা শুরু করবে সেটা সিদ্ধান্ত নিতে বিড়ম্বনা হচ্ছে। 


তারপর কিছু না ভেবে বললো, আপনার মায়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে জোহরের নামাজের পরেই। আমি মাহাতাবুর রহমান মুহিত সাহেবের কাছে আপনি আসার খবর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন যে আপনার জন্য লাশ দাফন করা নাকি বন্ধ রাখা যাবে না। আপনার সাথে লাশের দেখা হোক বা না হোক তাতে কোন সমস্যা নেই। 


- মিলি কিছু না বলে শুধু চুপচাপ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। 


- সাইফুল বললো, আপনি বলেছিলেন যে যিনি মারা গেছে তিনি নাকি আপনার মা, তাহলে কেন আপনাকে দেখানোর দরকার নেই তাদের? আর আপনার বিষয় সেখানের কেউ আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। 


- মিলি বললো, আমি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই, আপনি কি আপনার মোবাইলটা কথা বলার জন্য দিবেন? 


- হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই দেবো। গতকাল রাতে যে নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলেছেন সেই নাম্বার তো? 


- জ্বি সেটাই। 


- তিনি সকাল থেকে অনেকবার কল দিয়েছেন আমার নাম্বারে। আপনার জন্য তার খুব টেনশন হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে ভালো করে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জট পাকিয়ে যাচ্ছে তাই সেগুলো নিয়ে অস্বস্তি হচ্ছে। 


- আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনার সকল জট ছাড়িয়ে দেবো। 


- আচ্ছা। 


মিলির বাবার কাছে কল দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে মিলির বাবা বললোঃ-


- হ্যালো হ্যালো। 


- বাবা আমি মিলি। 


- মা মিলি? কেমন আছো তুমি? শুনলাম সকাল থেকে তুমি অসুস্থ কিন্তু এতদূর থেকে আমি কিছু করতে পারি না। আমি রওনা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সাইফুল নামের এই ছেলেটা নিষেধ করলো। তবুও আমি ভেবেছিলাম আজ রাতেই রওনা হয়ে যাবো বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে। 


- তুমি শান্ত হও বাবা, আমি ঠিক আছি। সকাল বেলা হঠাৎ করে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাথাটা কেমন হয়ে গেল। এখন ঠিক আছে। 


- আমি রাতের মধ্যে তোমাকে নিতে আসতেছি। 


- কেন শুধু শুধু কষ্ট করবা? আমিই চলে আসবো তোমার কাছে। সম্ভব হলে আজকে রাতেই রওনা দিলাম আর নাহলে আগামীকাল সকালে নিশ্চিত। 


- তোমার মায়ের কাছে যাবে না? 


- না বাবা, আজকে আমার মায়ের মৃত্যুর খবর ছাড়াও অন্য একটা স্মৃতি মনে পরেছে বাবা। আর সেই স্মৃতির জন্য আমার খুব বেশি খারাপ লাগে। 


- কিসের স্মৃতি? সজীব এর বিষয় কিছু? 


- না বাবা, বছর খানিক আগে আমার একটা ময়না পাখি ছিল তোমার মনে আছে? 


- হ্যাঁ মনে আছে। সারাদিনের সকল কাজ ছিল একদিকে আর সেই ময়না পাখি ছিল একদিকে। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি নিজের হাতে তাকে গলা টিপে মেরে ফেললে, কারণটা অজানা। 


- আজকে আমার সেই ময়না পাখির কথা খুব বেশি মনে পরেছে বাবা। 


- কিন্তু কেন? আর তুমি কি তোমার মায়ের দেহ শেষ দেখা দেখতে পেরেছ? 


- না বাবা মায়ের সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না বাবা। তার কবর দেখতে ইচ্ছে করছে না তাই সেটাও দেখতে যাবো না। 


- তাহলে? 


- বললাম যে ফিরে আসবো তোমার কাছে। 


- আচ্ছা ঠিক আছে। 


- বাবা আমি ময়না পাখিটা কেন হত্যা করেছিলাম জানতে চাও? 


- আগে তুমি সুস্থ শরীরে ঢাকায় ফিরে আসো তারপর সবকিছু শুনতে পারবো। 


- কিন্তু আমার যে এখনই বলতে ইচ্ছে করছে। 


- কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না কারণ আমি জানি তুমি এখন খুব অদ্ভুত কথা বলবে আর সেই অদ্ভুত কথার তীব্রতা অনেক গভীর। আমি এখন তোমার সাথে কোন কথা বলবো না, তুমি কালকে সকালে উঠে রওনা দিয়ে চলে আসো তারপর তোমার সাথে কথা হবে। 


- ঠিক আছে বাবা। 


মোবাইল কেটে দিয়ে মিলি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, তার সামনে সাইফুলসহ আরো কিছু মানুষ কৌতুহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য সহজে গ্রামের বাড়িতে দেখা যায় না, গ্রামের মানুষের জীবন হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবন। তাদের সেই জীবন চলার মধ্যে কোন সমস্যার স্থান নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে পাখি যেমন করে নিজের বাসায় ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায়। ঠিক তেমনি করে গ্রামের মানুষগুলো দিনের ব্যস্ততা শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের প্রথম প্রহরে সুষুপ্ত। অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখা যায় ইট পাথরের শহরে প্রতিটি গলিতে গলিতে। সম্পুর্ন শহরটা যেমন কৃত্রিম ইট-পাথরের দালান-কোঠা রাস্তা দিয়ে তৈরী, তেমন করে সব মানুষের জীবন অন্যরকম লাগে। শহরের প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে, কারো জীবনের গল্প খুব মধুর আবার কারো জীবন খুব করুণ। 


সাইফুল এক এক করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর মিলি খুব সংক্ষিপ্ত আকারে সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। যদিও মিলির জবাব খুব ছোট কিন্তু সেটা সাইফুল ঠিকই বুঝতে পারছে। সবকিছু শুনে সাইফুল শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ঠিকই কিন্তু কিছু বলার মতো ছিল না। সকল কথার মধ্যে সজীব এর সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সজীব সেদিন রাত থেকে আর কল করেনি আবার মিলিও নিজে ইচ্ছে করে বিরক্ত করে নাই। 


----


সকাল ৭ঃ৩০ মিনিট। 

মিলি আর সজীব দুজনেই একসাথে বাসের মধ্যে পাশাপাশি বসে আছে। বাস চলছে আপন গতিতে আর সবাই অপেক্ষা করছে রাজধানী ঢাকা শহরে পৌঁছে যেতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইফুল মিলির সঙ্গে এসেছে কারণ এমন একটা ঘটনার পরে তাকে একা পাঠানো ঠিক নয়। কথাটা বলেছিলেন সাইফুলের দাদা মানে তালুকদার সাহেব। তাই সে বাধ্য হয়ে মিলির সঙ্গে এসেছে, সাইফুল বলেছিল যে বাসের সুপারভাইজারকে ভালো করে বলে দিলে ঠিক মতো পৌঁছে দেবে। আর সমস্যা হলে মিলির বাবা বা সাইফুলকে যেন কল করে। কিন্তু সাইফুলের এই আবেদন তার দাদার আদালতে মঞ্জুর হলো না। 


মিলি বাসের মৃদু ঝাঁকুনিতে ঘুমিয়ে গেছে। মিলির মাথা জানালার সাথে মিশে আছে, চোখ দুটো বন্ধ কিন্তু স্বপ্নে মনে হচ্ছে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে। মিলি দেখলো যে তার পাশের সিটে তার মা বসে আছে যিনি পান খেয়ে ঠোঁট আর দাঁত লাল করে ফেলেছে। মিলি মন খারাপ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে তাকিয়ে রাস্তার পাশের সবুজ গাছগুলো পিছনে সরে যাচ্ছে সেগুলো মন দিয়ে দেখছে। 


- মিলির মা বললো, কি ভাবছো মা মিলি? 


- কিছু না। 


- নিশ্চয়ই ময়না "পাখির কথাগুলো" ? 


- কীভাবে জানলে? 


- তোমার বিষন্নতা প্রকাশ করছে। 


- তুমি তো মারা গেছো মা, তাহলে তুমি কীভাবে আমার পাশে এলে? আর আমি কি ভাবছি সেটা কীভাবে জানলে তুমি? 


- আমার মেয়ে আমাকে দেখার জন্য এতদূর ছুটে এসেছে কিন্তু আমি আজও স্বার্থপরের মতো তাকে ফেলে অনেক দুরে চলে গেলাম। সেই ছোটবেলা তাকে ফেলে চলে এলাম, আজ এতবছর পরে সে আমার সন্ধান পেয়ে আসলো তবুও আবার আমি চলে গেলাম। খুব খারাপ মানুষ আমি। 


- এসব কথা কেন বলছো মা? ভালো লাগে না শুনতে। 


- তোমাকে অসুস্থার কথা জানিয়ে এখানে আসতে বলা উচিৎ ছিল না। আমি তো জানতাম না যে আমি এত তাড়াতাড়ি মরে যাবো। মৃত্যুর কথা কি কেউ জানতে পারে রে? তবুও একটা বিষয় ভালো হয়েছে মিলি। 


- সেটা কি? 


- আমি তো তোমার বাবার আর তোমার কাছ থেকে অনেক দুরের ছিলাম। আমার ঠিকানা বা অন্য কিছু যোগাযোগ তোমরা জানতে না। আমি যদি এভাবেই চুপিচুপি মরে যেতাম তাহলে তো খবরটাও জানতে না কোনদিন। জীবনে আর কভু দেখা তো হতোই না, আবার তোমরা বাবা-মেয়ে জানতেই পারতে না। 


- হ্যাঁ তা ঠিক। 


- তুমি তোমার ময়না পাখিটা খুব ভালবাসতে তারপর একদিন সেই পাখিটিকে তুমি আমার কথা জিজ্ঞেস করলে। আমার সাথে দেখা হবে কবে সেটা তার কাছে জানতে চাইলে। কিন্তু সেই সময় ময়না পাখিটা সত্যি বলছিল। 

" সে বলেছিলঃ- তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে আর কোনদিন দেখা করতে পারবে না। তোমার মা খুব শীঘ্রই মারা যাবে আর তুমি খুব কাছাকাছি গিয়েও তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। "

পাখিটির কথা শুনে তোমার খুব কষ্ট হলো, বুকটা ভরে কান্না আসলো। তাই রাগান্বিত হয়ে তুমি তখনই সেই পাখির মাথা টেনে ছিড়ে ফেললে। তোমার সেই পাখির অপরাধ ছিল যে সে সত্যি কথা বলেছিল। সত্যি বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো তাকে তাই না মিলি? আর তুমি আজ যখন দেখলে "ময়না পাখির কথাগুলো" সবই সত্যি হয়ে গেছে তখন তার কথা খুব মনে হচ্ছে। 


- মিলি কিছু না বলে শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেললো। 


মোবাইলের শব্দে কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে গেল মিলি। তার মোবাইল এখনো ঠিক হয়নি কিন্তু সে তার একটা সিমকার্ড অন করেছে সাইফুলের বাটন মোবাইলে। সেই মোবাইলে হঠাৎ করে সজীব কল দিয়েছে দেখে অবাক হলো মিলি। 


- রিসিভ করে চুপচাপ রইল মিলি। 


- সজীব বললো, কেমন আছো তুমি? কোথায় আছো এক্ষুনি বলো আমাকে। আমি তোমাকে নিয়ে আসবো গিয়ে। 


- মিলি বললো, কেন ব্যস্ত হচ্ছ? তোমার সবকিছু ঠিক আছে তো? বাসার সবাই ভালো তো? 


- সবাই ভালো, আর আমি সরি মিলি। তোমাকে এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু তবু কেন যেন হয়ে গেছে না চাইতেই, প্লিজ ক্ষমা করো। তুমি আজই ঢাকা চলে আসো, আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে বিয়ে করতে চাই মিলি। 


- মিলি চুপচাপ। 


- তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ মিলি? আমি তোমাকে যা যা বলছি শুনছো? 


- নাহহ। 


- কেন? 


- আমি এই মুহূর্তে শুধু একটা কথা শুনতে পাচ্ছি। 


- কি কথা? 


- আমার সেই ময়না পাখির কথাগুলো। 


- মানে কি? 


- কিছু না, রাখলাম তাহলে? আমি গাড়ির মধ্যে বসে আছি তাই পরে কথা হবে। 


------ সমাপ্ত ------


লেখাঃ-

মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)


সব ধরনের গল্প পড়ুন।