বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

 (প্রাপ্ত বয়স্ক এবং উন্মুক্তমনাদের জন্য)  

পাশের ঘর থেকে আসা খাটের কটকট শব্দে রাহেলা খাতুনের আধো আসা ভাত ঘুমটা ভেঙ্গে যায়, বিরক্তিমাখা মুখ ঘুরিয়ে উনি উপরের খড় কুটো দেওয়া চালার দিকে তাকান। এর পরেই হাঁক ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলে বসেন, 

___ " এগুলানের কুনু শরম লাজের বালাই যে নাই, দিন দুপুরে মানু হজাগ কইরা শুনাইতে লাগছে যে ঘরে বেডা আছে! আবাগীর বেডিরে জুতাইয়া সোজা করনের কাম।"

শাশুড়ীর মুখের এই এক কথাতেই সালেহা লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইলো। ওর বুকের উপরে থাকা বেলালও চুপ করে মায়ের মুখের কথা শুনতে থাকলো৷ সালেহা যখন মুচড়ে বেলালের বুকের নিচ থেকে বের হতে চাইলো, বেলাল তখন আরো যেতে ধরে বলল,

___ " কই যাইতাছো, আমার মনডা যে ওহনও ভরে নাই!"

___ " আপনের মন ভরনের কাম নাই, আম্মা কিমুন তারা চিল্লাইতে দেখছেন। আমারে ছাড়েন কইতাছি, আম্মার গালি তো আপনে হুনেন না আমার হুনতে হয় "।

সালেহা দাঁতে দাঁত পিষে বলেই আবার মোচড়াতে লাগলো। এবার বেলাল সালেহার গলার নিচে মুখ দিয়ে আদর করতে করতে বলল,

___ " আমি কি আরেক বেডিরে আদর করি নি, আমার আমার বউডারে আদর করতাছি, তাতে কার কি! "

___ " ও মা মা তাই নি, ঠিক আছে যান এই কথাডা আমনে আমনের মায়ের সামনে যাইয়া কইয়া আসেন। তহন বুঝমু আমনে কতবড় বেডা "।

এটুকু বলেই সালেহা ফিক করে হেসে দিল, আর সেই মাতাল করা হাসিতে বেলাল যেন সালেহার মাঝে আরো ডুবে গেল৷ 


রাহেলা খাতুনের একমাত্র ছেলে বেলালকে বিয়ে করিয়েছেন পাশের গ্রামের সালেহার সাথে মাস তিনেক আগে। তাদের সম্পদ বলতে বসত ভিটাটুকু আর ঘরের পাশের কয়েকশতক ক্ষেতের জমি। বেলালের বাবা ওর ছোট বেলাতেই মারা গিয়েছেন, সেই থেকে রাহেলাই বেলালকে মানুষ করেছেন। আর দশটা শাশুড়ীর চেয়ে সে একটু ঢের বেশিই কড়া, সেটা একয়েক দিনেই সালেহা বুঝে গিয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই মোটামুটি গালির বন্যা বয়ে যায়। সালেহা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে, একটা মানুষ এত এত গালি কি করে দিতে পারে? 

কিন্তু ওর শান্তির জায়গায় হলো বেলাল, হাজার বকার মাঝে বেলাল যখন ওকে হঠাৎ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে চমকে দেয়, তখন মনে হয় দুনিয়ার সমস্ত সুখ যেন ঠিক ওর হাতের মুঠোয় এসে জড়ো হয়েছে। কিন্তু বেলাল যে সালেহাকে এত এত ভালোবাসে সেটা যেন রাহেলা খাতুনের সহ্যই হয় না। 


বেলাল যখন লুঙ্গিটা ঠিক করতে করতে ঘর থেকে বের হলো, পিছনে বিছানায় তখন সালেহা শাড়ি ঠিক করতেছে। এখন গোসল ছাড়া কোন কাজ ধরলেই ওর শাশুড়ী আর আস্ত রাখবে না ওকে। সালেহা তাড়াতাড়ি চাপা স্বরে বলল,

___ " ওই হুনেন, আপনে একটু পরে যান, আমি আগে নাইয়া আইয়া লই। "

বেলাল আবার ফিরে এসে সালেহাকে চোখের পলকে আড়কোলে নিয়ে বলল,

___ " লও আইজ্জা এক লগে নাইমু।"

___ " ইশশ, কি আমার শখ রে, আম্মায় টের পাইলে জানে মাইরা ফেলবো "।

একথা বলেই সালেহা গামছা নিয়ে এক দৌড়ে পুকুর ঘাটে দৌড় দিল। মগ ভর্তি পানি মাথায় ঢালতেই আরাম এসে যেন ভর করলও ওর শরীরে, দুপুরের প্রচন্ড গরমে এ যেন এক পশলা বৃষ্টির শীতলতা। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে বেলালের সাথে এক সাথে গোসল করতে, বিয়ের পর পরই একদিন বেলালের কথাতেই দুজনে এসেছিল পুকুর ঘাটে দুপুরে গোসল করতে। জলকেলি করতে করতে যখন ওরা গোসল করছিল, তখনই রাহেলা এসে দেখে পুকুরে ওরা একত্রে গোসল করছে। শাশুড়ীর রক্তচক্ষু দেখেই যেন সালেহা থমকে গিয়েছিল, আর সেদিন সারা দুপুর যেন ওর উপরে টর্নেডো বয়েছিল। একটাই অপরাধ কেন গিয়েছিল বেলালের সাথে গোসল করতে এই ভর দুপুরে। বেলালের মুখের দিকে ও চেয়েছিল করুন নয়নে, ভেবেছিল বেলাল অন্তত একবার কিছু বলুক, কিন্তু না বেলাল কিছুই বলে নি সেদিন। ওইদিন থেকেই সালেহা বুঝে নিয়েছিল যা করার শাশুড়ীর মন মতই করতে হবে, স্বামী ভালোবাসলেও সে শাশুড়ীর সামনে নাচার৷


রাতে ভাত বেড়ে প্লেটে দিচ্ছিল সালেহা, রাহেলা আর বেলাল খাচ্ছে৷ রাহেলার মুখটা থমথমে হয়ে আছে, সালেহা জানে দুপুরের সেই ঝাল যতক্ষন না মিটাবে ততক্ষন শান্ত হবে না রাহেলা। ভাত প্রথম লোকমা সবে মুখে দিয়েছে বেলাল, ঠিক তখনই তার মা বলে উঠলো, 

___ " বাপ, বিয়া না হয় করাইছি এক আবাগীর বেডির লগে তাই বইল্লা তোরও কি হেদাত বেদাত থাকবো না? তুই ও কি এই আবাঙ্গালের লাহান হইয়া গেলি নিহি"।

বেলাল কিছু না বলে চুপচাপ ভাত গলধঃকরন করতে লাগলো, আর সালেহা খুটিঁ ধরে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো। আরো বেশকিছু কথা শুনিয়ে রাহেলা বেগম ক্ষান্ত হলেন। 


রাতে শোয়ার পরে যখন বেলাল সালেহার গায়ের উপরে হাত দিল, ঝাড়া দিয়ে ওর হাতটা সরিয়ে দিল ও। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তখনও ও কেঁদেই যাচ্ছে, শাশুড়ীর বকুনিতে ও কাঁদেনি মোটেও কাঁদছে ওর স্বামীর নিরবতায়। বেলাল ওকে আদর করেছে, ও তো বলেনি তাকে আদর করতে তাহলে এখানে ওর দোষটা কই, কেন অকারণে বারবার ও কথা শুনবে।


বেলাল আস্তে আস্তে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, 

___ " ও বউ, বউরে রাগ কইরো না তুমি আমার লগে। মায়ে তো বুড়া মানুষ হে দুই কতা কইলে নিজের মা ভাইব্বা কথা গুলান হুইন্না নিও। আমার সোনা বউ টা, আর কাইন্দনা কিন্তু।"

বেলালের এই আদর কথা কথা শুনে যেন সালেহার কান্নায় বাঁধ ভাঙ্গলো, ঘুরে বেলালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলল ও। বেলাল আলতো করে সালেহার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,

___ " জানো বউ আমার মায়ে না আমারে খাইয়া না খাইয়া পালছে, এর বাড়ি ওর বাড়ি কাম কইরা নিজে উপোস থাইক্কা আমারে আইজ এই জায়গায় আনছে। কও আমি কেমন তারা মায়ের মুখে মুখে তক্ক করমু তোমারে নিয়া। "

একচোখ ভরা পানি নিয়ে সালেহা তাকালো বেলালের মুখের দিকে। কিছু কিছু জায়গায় যেন কোন কথাই চলে না, তাই সালেহা চুপ করে স্বামীর বুকের উষ্ণতার মাঝে নিজের মনের ক্ষতটুকু ভরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পাশের ঘর থেকে আরেকজন অশ্রুভরা নয়নে কথা গুলো শুনে পাশ ফিরে কোলবালিশটাকে আঁকড়ে ধরলো। কিন্তু সালেহার সাথে তার তফাৎটুকু হলো সালেহা কারো বুকে মাথা রেখে কাঁদছে, কিন্তু অন্য মানুষটাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতন কেউই যে নাই। 


কয়েকদিন পরে বেলাল সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে এলো উত্তেজিত হয়ে, সালেহা তখন বাইরে উঠানে মেলে দেওয়া কাপড় তুলছিল ঘরে নেওয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি বেলাল সালেহার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে ঘরে ঢুকেই খিল দিলো দরজায়, তারপর আস্তে আস্তে বলল,

___ " রাইতে পাশের গাঁয়ে যাত্রা পালা হইবো, যাইবানি দেখতে তুমি! "

___ " হ, যাইমু, "। 

এটুকু বলেই সালেহার উত্তেজনায় হঠাৎই ভাটা পড়ে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

___ " আম্মায় যাইতে দিবো না যে, কি করমু আম্মেই কন। থাকুক গা আপনেই যাইয়া দেইক্কা আহেন! "

___ " না আমিও যামু, তোমারেও লইয়া যামু। হুনো আম্মায় ঘুমাইলে আমি পিছনের বেড়ায় ধাক্কা দিলে আস্তে কইরা বাইর হইয়া আইবা "।

___ " কিন্তুক.......... "

___ " কোন কিন্তুক না যা কইছি তাই... "!

রাতে বেলাল যখন রাহেলা খাতুনকে যাত্রা দেখার কথা বলে বের হয়ে গেল সে আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। বেলাল বের হয়ে যেতেই রাহেলা সালেহার পাশ ঘেঁসে বসতে, রাহেলার হঠাৎ এমন আচরণে সালেহা যেন কুঁকড়ে যায় বেশ খানিকটাই। রাহেলা আস্তে আস্তে বলল,

___ " তুই আমারে অনেক ঘেন্না করস, তাই না রে বউ। "

___ " না আম্মা এগুলান আমনে কি কন! আপনে মুরব্বি আপনেরে আমি কিজন্য ঘেন্না করমু কন"!

___ " আমিও আমার শাশুড়ীরে ঘেন্না করতাম, আমি জানি তুইও আমারে ঘেন্না করস। জানোস আমি তো তোরে পেট ভইরা খাইতে দেই, আমারে কোনদিন পেট ভইরা খাইতে দেয় নাই। আমারে মাঝে মাঝে তার লগে আইন্না শোয়াইতো, তোর শশুরে আর আমি সারা রাত এইপাশ ওইপাশ করতাম। খালি মনে হইতো হের লগে যদি একটু শুইতে পারতাম। বেলাল পেডে আইলে কত কি খাইতে মন চাইতো, কুন সুম তোর শশুরে সাহস করতো না আমারে খাওন আইন্না দিতে৷ "

এটুকু বলেই রাহেলার গলা ধরে আসলো। সালেহা শাশুড়ীর পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, কখন যে ওর চোখও পানিতে ভরে গিয়েছে সেটা যেন টেরই পায় নি ও। 

___ " জানোস বউ, আমারে না চ্যালা কাট দিয়ে মারতো, যদি কুনসুম কাইন্দা বইতাম তাইলে আরো মারতো। বেলালের বাপে কুনু দিন আউজ্ঞায় নাই। চুপ কইরা দূরে দাঁড়াইয়া দেইখাই গেছে আমার মাইর গুলান। আমিও আমার শাশুড়ী লাহান হইয়া গেছি, তোর উপরে আমি জুলুম কইরাই যাইতাছি।"

এটুকু বলেই রাহেলা খাতুন উঠে যেয়ে নিজের ঘরের খিল লাগালো। সালেহা অবাক চোখে শাশুড়ীর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। এ যেন অন্য এক রাহেলার দেখা পেলো সে, সেই কতকাল আগের তারই বয়সী এক বউয়ের অব্যক্ত যন্ত্রণার গল্প যেন শুনলো আজকে। 


একটু পরেই যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল বেড়ায় আস্তে আস্তে টোঁকার শব্দ শুনেই সালেহা ধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বেলালের হাত ধরে ও যখন বেরিয়ে এলো তখন রাহেলা খাতুন পাশ ফিরে আস্তে করে শুয়ে মুচকি হাসলেন। মনে মনে ভাবতে থাকলে সকালে কি বলে বকা দেওয়া যায় দুটোকে। 


-চক্রাকার

-মারিয়া আফরিন নুপুর


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।