রহস্যময় গল্প

রহস্যময় গল্প

"তুই- ই তো আমার ইজ্জত কেড়ে নিয়েছিলি। বহুদিন পর পাইছি তোরে। আজ কোথায় যাবি? না তুই না, তোর তো গোঁফ নেই। যে আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিল তার গোঁফ ছিল"


আজ মনে হয় গোঁফ না থাকার জন্যই বেঁচে গেছি। প্রকাশ্য দিবালোকে, চলাচলরত মানুষের সামনে আমাকে যে অপবাদ দিয়েছিল ভয় না পেয়ে উপায় আছে? 

খানিকটা পেরিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম পিছনে আরেক মধ্যবয়সী লোককে একই কথা বলছে মেয়েটি। আবারো বলল, "না তোর পড়নে লুঙ্গি, যে আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিল তার পরনে প্যান্ট ছিল, জিন্স প্যান্ট।"


মেয়েটিকে দু'দিন যাবৎ এই রাস্তার মোড়ে দেখা যায়। আগে কেউ কখনো এই পাগলিটাকে দেখেনি। আর এই একই কথা সবাইকে বলে বেড়ানোর কারণে দুই দিনেই মেয়েটির কথা মানুষের মুখে মুখে। অনেকেই জানতে চায়, "কোথায় বাড়ি তোর? এখানে এলি কেন?" তখনই মেয়েটি বলে, "তুই-ই তো আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিলি" 

ভয়ে আর কেউ কিছু বলে না। কী দরকার আছে নিজের ইজ্জত নিলামে তোলার?


অনেকে মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকায়। বাইশ-তেইশ বছরের যুবতী, ওড়না ছাড়া রাস্তায়। ছেঁড়া কামিজের ফুটো দিয়ে পেট কিংবা শরীরের কিছু অংশের দেখা মিলে। 

যুবক কিংবা মধ্যবয়স্ক কেউ কেউ বেড়ার ফাঁক মনে করে পলক না পড়া চোখে তাকিয়ে ক্ষুধার্তের মতো ঢেকুর তুলে। কোনো স্বাভাবিক মেয়ে এখানে থাকলে লোকজনের চোখের শিকারে মৃত্যুবরণ করত। 

কেউ খাবার দিলে মেয়েটি খায়। কখনো খাবারের কিছু অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখে। চুলগুলোতে ধূলোবালিতে জট ধরার উপক্রম। মেয়েটির মুখে অন্য কোনো কথা কেউ শুনেনি। সকালে না-কি একবার পুলিশ যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিল। 


আমাদের এলাকায় সহজে পুলিশ আসে না। বছর দেড়েক আগে একবার পুলিশ এসেছিল। পূর্ব পাড়ার তানিয়া যখন ফাঁসিতে ঝুলছিল। তখন পুলিশ এসে লাশ নামিয়ে ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করেছিল। তানিয়াদের বাড়ির পরে একটি ডোবা। ডোবার পরে ছোটো একটি ভিটা। তিনটি মেহগণি গাছ আর ছোটো ছোটো কিছু ঝোঁপ রয়েছে। তানিয়া ঝুলছিল মাঝখানের মেহগণি গাছে। তানিয়ার মা বারবার বলছিল, "আমার মেয়ে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে নিশ্চয় খুন করা হয়েছে"

খুবই আশ্চর্যের বিষয়। তানিয়া সে ডোবার পরের ভিটাতে ফাঁসিতে ঝুলছিল। অথচ তার কাপড় শুকনো ছিল। সাধারণত কেউ ডোবা পেরিয়ে যেতে হলে তার কোমড় অবধি ভেজা থাকার কথা। 

ময়না তদন্তে রিপোর্ট যখন আসল তখন সবার চিন্তার অন্ত নেই। কারন ফাঁসিতে ঝুলার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। 


মামলা করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ মামলার আসামী অজ্ঞাত। পুলিশ দুয়েকদিন এসে যাকে সামনে পায় তানিয়া সম্পর্কে দুয়েক কথা জানতে চেয়েছিল। সপ্তাহ-পনেরো দিন পর থেকে আর কোনো হদিস মেলেনি তানিয়ার ব্যাপার নিয়ে। 


আমাদের এলাকার "আসলাম" আর "মাহবুব" কে আমি অনেক ভয় পাই। শুধু আমি নই, এলাকার অনেকেই ভয় পায়। কেউ তাদের সাথে কথাও বলতে চায় না। বড়ো বড়ো চোখ করে এদিক সেদিক তাকায়। অনেকেই বলাবলি করে তারা না-কি উপর মহলের ডান হাত। কেউ বলত ক্যাডার বাহিনীর লিডার। একজনও বিয়ে করেনি। কেউ কেউ বলে তাদের নজর খারাপ। 


রিক্সা থেকে নেমে দেখি পাগলি মেয়েটা মোড়ের দোকানটার একপাশে বসে রুটি খাচ্ছে। দুপুর সময়, দুয়েকজন দোকানের বেঞ্চটিতে বসে পাগলির খাওয়া দেখছে। কেউ কিছু বলে না। বললেই ধর্ষক বানিয়ে দেয় মেয়েটি। 

আমি দোকানে গেলাম কয়েলের প্যাকেট কিনতে। রাতের বেলা মশাগুলো বড্ড জ্বালাতন করে। 

পাশ দিয়ে মাহবুব আর আসলাম এসে হাজির। দোকারদার মামুন ভাইকে বলছে বেনসন সিগারেট দিতে দুই প্যাক। 

আমি তাদের দেখে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছি। তাদের আগে দেওয়া হলেই আমি মশার কয়েল নিয়ে বাড়ি ফিরব। 

আসলাম বড়ো বড়ো চোখ করে পাগলির ছেঁড়া কাপড়ের ফাঁক ফোকড়ে তাকিয়ে মাহবুবকে বলছে, "মাবু, দেখছস মাইয়াটা? রাতের বেলা পাই না কেন?"

আমি শুনতে পাইনি এমন ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। 

মাহবুব পাগলিকে বলছে, "কিগো, বাড়ি কোথায় তোর? রাতে থাকিস কোথায়?"

পাগলিও শুরু করে দিয়েছে, "তোরা-ই তো আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিলি, এতদিন পর পাইছি তোদের।" 

মাহবুব আর আসলাম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। 

মাহবুব বলছে "তাই না-কি? তো আজ রাতে আবার লুণ্ঠন করব, কোথায় থাকিস রাতে?"

আসলাম চিকন সুরে বলছে, "মাবু, চোখে চোখে রাখতে হবে। রাতে বুড়ির ভিটায় নিয়ে যাব।"


কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। তানিয়া যে ভিটায় মেহগণি গাছে ফাঁসিতে ঝুলেছিল সে ভিটাকে বুড়ির ভিটা বলে। কেউ কেউ নাকি গভীর রাতে সে ভিটায় এক বুড়িকে সাদা কাপড়ে ঘুরতে দেখত। সেই থেকে এটা বুড়ির ভিটা। তাহলে কি তানিয়াকে মারার পিছনে তাদের হাত ছিল?


রাত সাড়ে আটটায় শামীম ফোন দিয়ে বলছে "তারাতারি মোড়ে আয়, ঐ পাগলি তো একজন পুলিশ"

কথাটা শুনে অনেকটাই অবাক হয়েছি। তাড়াতাড়ি করে মোড়ে গিয়ে দেখি ঘটনা সত্য। দুই গাড়ী পুলিশ উপস্থিত। আসলাম, মাহবুব আর তাদের সাথের একজনকে চিনি না, মোট তিনজনের হাতে হাতকড়া আর কোমড়ে দড়ি। মেয়েটি আরেক পুলিশের সাথে কথা বলছে। পাগলির শরীরে এখনো ছেঁড়া কাপড়। 

পাগলি মেয়েটি হঠাৎ চেচিয়ে উঠল, "এভাবে যে ভীড় করে আছেন, আধা ঘন্টা আগে তানিয়ার বাবাকে খবর দিতে বলেছিলাম, কেউ খবর দিয়েছেন?

তানিয়ার বাবা ভীড় ঠেলে এসে বলছে, "এসেছি আমি।"

পাগলিটি এবার বলছে, "আঙ্কেল আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি তানিয়া হত্যা ও নির্যাতনের একটি মামলা করেছিলেন। ঘটনাটি যেখানে ঘটেছিল সে জায়গাটিকে বুড়ির ভিটা বলে?"

তানিয়ার বাবার সরল স্বীকারোক্তি, "হ্যাঁ, সেটা বুড়ির ভিটা"

পাগলিটি একটি কাগজে কী যেন লিখল। তারপর বলল, "আপনি রবিবারে কোর্টে যাবেন। আপনার মামলাটি আবার চালু করবেন। সেই মামলার একটি ফটোকপি নিয়ে থানায় আমার সাথে দেখা করবেন। "

বলেই মেয়েটি পুলিশের গাড়ীতে উঠে গেল। 


এতক্ষণে সব বুঝতে পেরেছি। মেয়েটি তাহলে এতদিন তানিয়ার খুনীদের ধরার জন্য পাগল সেজে ঘুরত। ছয় দিন মেয়েটা পাগলের অভিনয় করে গেল অথচ কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। 

রাতের বেলা মাহবুব, আসলাম আর তাদের সাথে একজন। তিনজনে মিলে পাগলিকে টানাটানি করছিল বুড়ির ভিটায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। দোকানের বেঞ্চিতে বসা ছিল কাঁধে গামছা দেয়া এক সাধারণ দিনমজুর। সে পুলিশের সদস্য ছিল। অবস্থার পরিস্থিতী খেয়াল করে বেঞ্চের লোকটি ফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। 


সে যাই হোক, শয়তান আসলাম আর মাহবুবের শাস্তি হওয়া দরকার। তানিয়ার মতো মেয়েটির সুন্দর জীবনটা কেঁড়ে নিল তারা। তাদের ফাঁসি হলে আমি মহাখুশি হবো। আইন যদি সুষ্ঠ বিচার করে।


গল্প: বুড়ির ভিটা

লেখা: সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,,,,  

,,,,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ


এমন আরও অনেক বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন।