বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

গল্প: খোলা জানালা ১ থেকে ৩ পর্বের সম্পূর্ণ গল্পটা পড়ুন।

বাসর ঘরে বসে আমার বর নাঈমের সাথে গল্প করছি।নাঈম আমার হাত ধরে বসে আছে।আর ঠিক তখন দরজায় কেউ ঠুকঠুক করে শব্দ করলো।নাঈম উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন আমার শাশুড়ি। তিনি এসেই আমার গলা থেকে সোনার চেইনটা একটানে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর জোর করে হাত থেকে বালা দুটো খুলে নিলেন।বালা খোলার সময় মনে হলো এই বুঝি আমার হাতটা ছিঁড়ে যাচ্ছে! তারপর যে কান্ডটা করলেন তা আরো ভয়ংকর।


 কোন সাধারণ মানুষ কোনদিন এমন কাজ করতে পারবে না। কিন্তু আমার শাশুড়ি করলেন। তিনি একটানে আমার কান থেকে ঝুমকো দুটো ছিঁড়ে নিলেন।আর নিলেন নাকফুলটাও। সঙ্গে সঙ্গে আমার কানের লতি থেকে আর নাকের মাংস থেকে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো।আর ব‍্যাথায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো সারা শরীর। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম।গা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। মুহুর্তে রক্তে আমার শাড়িখানা ভিজে উঠলো।আর বিছানায় বিছানো গোলাপী চাদর,সাদা গোলাপ ভিজে লাল টুকটুকে হয়ে উঠলো।


আমি ভয়ার্ত চোখে আমার শাশুড়ির দিকে তাকালাম। তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।ও পাশে নাঈম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার শরীরও কেমন থরথর করে কাঁপছে।আমি এবার অসহায়ের মতো হাউমাউ করে কেঁদেই উঠলাম।আমার শাশুড়ি তখন আমায় ধমকে উঠলেন।ধমকে উঠে বললেন,


--- 'চুপ।একদম চুপ।গলা বাড়াইলে গলাও ছিঁইড়া ফেলবাম টান মাইরা!'


আমি চাপা কান্নার গলায় বললাম,


--- 'আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন?'


আমার শাশুড়ি তখন বললেন,


--- 'প্রতিশোধ নিচ্ছি প্রতিশোধ।তোর বাবা আজহার মাস্টারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক ছিল। কিন্তু তোর মা ছলে বলে তাকে নিয়ে পালিয়েছিলো! সেই বিয়ে ভাঙার কত কষ্ট ছিল তা আমি কাউরে বুঝাইতে পারবো না।কত অপমান আমার হয়েছিল তাও বুঝাতে পারবো না। আমি দু দুটো বছর ঘরের ভেতর দমবন্ধ হয়ে পড়ে ছিলাম।ঘর থেকে বের হতে পারিনি লজ্জায়। আর তখন থেকেই আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম এর প্রতিশোধ যতদিন আমি না নিতে পারবো ততদিন আমি শান্তিতে ঘুমাবো না।আজ আমার প্রতিশোধ নেয়া শুরু হলো!'


শাশুড়ির কথাগুলো শুনে আমার মাথা কেমন ভণভণ করে ঘুরতে লাগলো।ইনি কী সব কথা বলছেন! আমার মা তো এমন নন। তিনি কখনই তো এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারেন না!

কান আর নাকের ব‍্যাথা আমায় পাগল বানিয়ে তুলছে। আমি সহ্য করতে না পেরে আবার কাঁদছি। কিন্তু ভয়ে চুপিচুপি কাঁদছি।নাঈম এবার তার মাকে আস্তে করে বললো,


--- 'আম্মা যাও তো এবার। হয়েছে তো! একজন মানুষের সাথে কীভাবে আরেকজন মানুষ এমন হিংস্রতা দেখায়?'


নাঈমের কথা শেষ করতে দেরি হলো কিন্তু তার গালে তার মায়ের হাতের চড় পড়তে দেরি হলো না।আমার শাশুড়ি তার গালে চড় দিয়ে বললেন,


--- 'লায়েক হয়ে গেছস তুই?লায়েক হয়ে গেছস?গলা টিইপা দমডা বাইর কইরা ফেলবো!আজ থাইকা আমার কথার বাইরে যদি কিছু করবি তাইলে জানে মাইরা ফেলাইবো!'


নাঈম ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো।এবার আমার শাশুড়ি আমার সাথে কথা বললেন। তিনি আমার কাছে এসে বললেন,


--- 'একটা খেলা দেখাইবো এখন।খেলা দেখবা বউ?'


আমি শুধু জলভরা চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালাম। কিন্তু কথা বললাম না।এবার আমার শাশুড়ি নাঈমের দিকে তাকালেন।তারপর বললেন,


--- 'নাঈম,আমি যা বলবো এখন থাইকা তুমি কিন্তু আমার সাথে গলা মিলাইবা বাজান। আমার কথার বাইরে কিছু করলে তো জানোই!'


তারপর আমার শাশুড়ি এক অদ্ভুত কান্ড করলেন। তিনি চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন আশে পাশের মানুষদেরকে।


--- 'তোমরা‌ কেউ আসলা না গো আসলা না , আমার বউ পাগল হয়ে গেছে।কী সব্বোনাশ করছে গো দেখো আইসা তোমরা। নিজের নাক কান নিজেই ছিঁইড়া ফেলছে।'


বাইরের মানুষদের ডাকতে ডাকতে তিনি তার হাতে থাকা চেইন বালা আর কানের ঝুমকো ছড়িয়ে ফেললেন মেঝেতে।এবার তিনি মেঝেতে বসে কান্না শুরু করলেন।একে একে তখন আত্মীয় স্বজন আর আশে পাশের ঘরের মানুষগুলো আসতে শুরু করলো। তিনি তখন কাঁদতে কাঁদতে মাথা চাপড়ে বলতে লাগলেন,


--- 'কী সব্বোনাশ করলো গো, আমার পোলারে পাগল বউ গছাইয়া দিলো!'


আমার শাশুড়ির এসব কান্ড দেখে আমার বুক কেমন কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ের আশঙ্কায়। কেন জানি তখন আমার মনে হলো,আমি ভীষণ বড় বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। এই বিপদ থেকে বাঁচা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে!'

'

আত্মীয় স্বজনরা একে একে আমার চারপাশ এসে ঘিরে ফেললো। একজন বৃদ্ধ মহিলা এসে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে বললো,


--- 'সব্বোনাশ সব্বোনাশ,বউয়ের চোউখ দেখো কেমন টকটকা লাল ।এর জ্বীন আছে। কবিরাজ ডাকো তাড়াতাড়ি। নাইলে বিপদ হইবো'


আরেকজন অল্প বয়সী মহিলা তার মুখটা কেমন করে বলে উঠলো,


--- 'আরে এইসব কিছু না ।দেখেন গিয়া মাইয়ার নাগর আছে। নাগরের সাথে আগে ভাগেই ঢলাঢলি হয়ে গেছে। এখন জামাইর হাতে ধরা পড়বার ভয়ে এমন করতাছে!'


এই কথাটা শুনে আমার মেজাজ সত্যি সত্যি খুব বিগড়ে গেল।আর আমি তখন ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম,


--- 'মুখ সামলে কথা বলুন বলছি!'


এই কথা বলতেই আমার শাশুড়ি ওখানে উপস্থিত সবাইকে বললেন,


--- 'সবাই জলদি বাইর হইয়া যান।ঘর তালা দিয়া দেই। নাইলে কখন কী করে পাগলে আল্লাহ জানে!'


আমার শাশুড়ির কথায় সবাই তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমার শাশুড়ি তখন নাঈমকে বললেন,


--- 'তুইও বাইর হইয়া যা এইখান থাইকা।'


নাঈম যেতে চাইলো না।সে ঠিক দাঁড়িয়ে রইল।এবার আমার শাশুড়ি নাঈমকে ধমকে উঠতেই নাঈম ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তারপর আমার শাশুড়ি সবার শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে আমি চিৎকার করে বললাম,


--- 'প্লিজ!দরজাটা বন্ধ কইরেন না! আল্লাহর দোহাই দরজাটা বন্ধ কইরেন না। আমি এইখানে একলা ভয়ে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো!'


কিন্তু তিনি আমার অনুনয় শুনলেন না। দরজায় তালা আটকে দিয়ে চলে গেলেন!


গল্প: খোলা জানালা

পর্ব : ০১

অনন্য শফিক


খোলা_জানালা

২য়_পর্ব

অনন্য_শফিক

'

'

(২)

রাতে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।আর হঠাৎ করে বিছানার পাশে জানলায় ঠকঠক শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠলাম প্রচন্ড ভয় নিয়ে। তারপর ভাবলাম কী করবো আমি!ভয় লাগছিলো প্রচন্ড! যদি জানলার কাছে নতুন ফাঁদ পেতে রাখে আমার শাশুড়ি!তাই জানলা না খুলে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম খাটের উপর। এখনও নাক আর কান দুটো প্রচন্ড ব্যথা করছে।মনে হচ্ছে সেই ব‍্যাথায় আমি পাগল হয়ে যাবো। ঠিক এই সময় বাবা মার কথাও খুব মনে পড়লো। আমার বাবাকে আমি যতটুকু চিনি তিনি খুব সৎ এবং সাহসী পুরুষ।জীবনে কখনো তাকে কোনকিছু‌ নিয়ে সামান্য অবহেলা করতে দেখিনি। দেখিনি কারোর দু পয়সা মেরে খেতে।


 কারোর উপর মিথ্যে চাপিয়ে দিতে।বাবা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে একশোবার ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেন। এবং এই বিয়ের সিদ্ধান্তটাও তিনি খুব ভেবেচিন্তেই নিয়েছিলেন।বাবা বলেছিলেন তার ছাত্রীর ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলে এতো বাছ বিচারের কী প্রয়োজন! তাছাড়া আমার শাশুড়ি আমার মায়েরও বান্ধবী। স্কুল জীবনে মার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার শাশুড়ির। তবে এটা সত্য আমার মা বাবার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পালিয়ে গিয়েছিলেন এই জন্য যে বাবা স্কুল মাস্টার হলেও তার ধন সম্পদ কিংবা বংশ-গৌরব অতটা উন্নত ছিল না। কিন্তু আমার নানা তৎকালীন সময়ের এলাকার প্রভাবশালী ব‍্যাক্তিদের একজন ছিলেন।অগাধ ধনসম্পদের মালিকও ছিলেন তিনি।নানা বাবা মার প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি বলেই বাবা মা পালিয়েছিলেন।বিয়ে করেছিলেন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে। তারপর ফিরে এলে নানা মেনেও নিয়েছিলেন সেই বিয়ে। আমি এতো কিছু জানলে ওই বিষয়টা কেন জানবো না যে আব্বার সাথে আমার শাশুড়ির বিয়ে ঠিক ছিল!

'

জানলায় এখনও শব্দ হচ্ছে। বিরতিহীন।ঠক ঠক ঠক। ভাবলাম জানলাটা একবার খুলেই দেই!

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা নাঈম ছাড়া আর কেউ না। নাঈমের প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ আছে। এই রাগটা অন্তত ঝেড়ে নেয়া যাবে এখন।আর কোনভাবে এখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারলে এদের প্রত‍্যেকটার নাকে বড়শি দিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়বো!


মনে প্রচন্ড সাহস নিয়ে জানলা খুলতেই দেখি সারা শরীরে চাদর আবৃত কেউ দাঁড়িয়ে আছে

দেখে আমার হৃৎপিণ্ড কেমন কেঁপে উঠলো। এই গরমের সময় আবার চাদর পরে আসবে কে!এ এক নতুন ষড়যন্ত্র না তো?আমি তড়িঘড়ি করে জানলাটা লাগিয়ে দিতে চাইতেই চাদরের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেললো। ভয়ে আমি চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করতে পারলাম না। শুধু বড় বড় চোখে তাকালাম।আর তখন দেখি চাদরের ভেতর থেকে নাঈমের মুখটা বেরিয়ে আসছে। আমি তখন শব্দ করেই বলে উঠলাম,


--- 'হাতটা ছাড়ুন।হাত ধরেছেন কেন?'

--- নাঈম ফিসফিস করে বললো,'আস্তে।কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।'

--- 'কী দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে?'

--- 'তোমার সাথে কথা বলতেছি এইটা। আম্মা জানে আমি এখন ঘুমিয়ে গেছি। কিছুক্ষণ আগে মিছেমিছি নাক ডেকে প্রমাণ করেছি যে আমি এখন ঘুমে বিভোর। আমি ঘুমিয়ে গেছি এটা প্রমাণ হবার পর আম্মাও ঘুমিয়ে গেছে। আমি আসার সময় দেখে এসেছি আম্মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।'


আমার ঘেন্না হচ্ছিল ওর প্রতি। আমি ভাবতেও পারছিলাম না একটা ছেলে কী করে এমন কাপুরুষ হয়!আমি তখন রাগের গলায় বললাম,


--- 'আপনার মতন এমন কাপুরুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। আপনি আমার হাত ছাড়ুন।যান এখান থেকে। নাইলে আপনার মুখের উপর আমি বমি করে দিবো!'


আমি একটানে নাঈমের হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।নাঈম তখন কাচুমাচু করে বললো,


--- 'প্লিজ! তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমি আম্মাকে ম‍্যানেজ করে ফেলবো এক দুই দিনের ভেতর। আম্মা কোন কারণে তোমাদের উপর রাগ। সেই রাগ থাকবে না দেখো!'


আমি ওর কথা শুনে জানলার কপাটটা ঠাস করে লাগিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু এর আগেই ঘরের দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো আমার শাশুড়ি।তার সাথে আরো একজন কম বয়সী মেয়ে। আমার শাশুড়ি এসেই আমার চুল টেনে ধরে বললেন,


--- 'কার সাথে পিরিত করস হারামজাদি? আমি আগেই সন্দেহ করছিলাম তোরে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!'


বলে আমার মুখের উপর তিনি একদলা থুথু ছিটিয়ে দিলেন।আমি তখন চিৎকার করে বললাম,


--- 'আপনি এমন অসভ‍্যতামি করছেন কেন আমার সাথে? আমি আপনার ছেলের সাথে কথা বলছিলাম। নিজের স্বামীর সাথে কথা বলাও কী অপরাধ?'

--- আমার শাশুড়ি তখন বললেন,'তুই বললেই হইলো আমার ছেলের সাথে কথা বলছস! আমার ছেলে ঘরে ঘুমাচ্ছে।'

--- আমি তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম,'ওই দেখুন,জানলার বাইরে দেখুন আপনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।'


কিন্তু আমার শাশুড়ি যখন তাকালেন তখন দেখা গেল নাঈম আর ওখানে নাই।আমার শাশুড়ি তখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আমার গালে ক্রমাগত চড় বসিয়ে দিতে শুরু করলেন।আর ওই মেয়েটি বাড়ির সকলকে ডেকে তুলতে লাগলো এই বলে যে,


--- 'আপনারা উঠেন। সবাই ঘুম থেকে উঠেন। উঠে দেখেন নতুন বউ তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে খালাম্মার হাতে ধরা খাইছে !'

'

(৩)

সারা পাড়া জেনে গেলো আমার সম্পর্কে।সবার মুখে এক কথায় নাঈমের বউ ভালো না। নাঈমের বউ ভালো না।বাসর রাতে নিজের বর রেখে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়েছে নাঈমের বউ। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!নাঈম তার মার কাছে এসে বললো,


--- 'আম্মা, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করতেছো। এইসব করে কিন্তু নিজের মান সম্মান নষ্ট করতেছো!'


আমার শাশুড়ি তখন রেগেমেগে আগুন হয়ে নাঈমকে বললেন,


--- 'লায়েক হয়ে গেছো তুমি?বউয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেছে।যে মা তোমারে জন্ম দিছে তারে ভুইলা এখন বউয়ের সাফাই গাও! আমারে মান সম্মান শিখাও?'


নাঈম এবার ধীরে সুস্থে তার মাকে বললো,


--- 'আম্মা, তুমি প্রতিশোধের আগুনে কান্ড জ্ঞান হীন হয়ে পড়েছো! আর প্রতিশোধ তুমি কার থেকে নিচ্ছো? মীরার কী অপরাধ এখানে? ভুল করলে তার বাবা মা করেছে।সাহস এবং শক্তি থাকলে তার বাবা মাকে শাস্তি দাও।কথা শোনাও!'


নাঈমের মা ছেলের এমন প্রতিবাদী কন্ঠ শোনে খুব একটা অবাক হলেন না। বরং ঠোঁটের কোণে দুষ্টু এক চিলতে হাসি নিয়ে বললেন,


--- 'জানাবো।ওর মাকে এক্ষুনি জানাবো।জানাবো, কেমন পতি*তা মেয়ে জন্ম দিয়েছে সে এই কথা! আমার কথা শোনার পর ওর মা গলায় দড়িও দিতে পারে লজ্জায়!'


নাঈমের মায়ের কথাগুলো শুনে লজ্জায়, ঘৃণায়,দুঃখে আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হলেও প্রতিবাদ করছি না। প্রতিবাদ করছি না এইজন্য যে আমি এখানে মুখ খুললেই এখানে জমায়েত লোকেরা আমাকেই দোষবে। আমি যতই সত‍্য বলি তারা কখনো আমার সত‍্য তাদের কানে তুলবে না।কিন্তু নাঈমের প্রতিবাদ আমার ভালো লাগছে। গতরাতে যে কাপুরুষ নাঈমকে আমি দেখেছিলাম সেই নাঈম আর এই নাঈমের মধ্যে অনেক পার্থক্য!নাঈম এবার তার মাকে বললো,


--- 'তুমি মিথ্যে করে মীরাকে দোষছো। গতকাল আমিই জানলা দিয়ে মীরার সাথে কথা বলছিলাম।'


--- নাঈমের মা মুখ ভেঙচিয়ে বললেন,'বললেই হলো! আমি দেখেছি তুই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস। এখন বউকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলছিস।'


--- নাঈম তখন শব্দ করে হেসে বললো,'আম্মা, তুমি না মা!মা কী করে সন্তানকে এমন নিকৃষ্ট আদেশ নিষেধ করে? এই যে গতকাল আমার বাসর ছিল। সেই বাসরকে তুমি রক্তাক্ত করেছো। নিজের পুত্রবধূর নামে মিথ্যা কুৎসা রটাচ্ছো! পুত্রকে নিষেধ করেছো স্ত্রীর কাছে যেতে। তোমার কথা মেনেই আমি বাসর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আসার পর মনে হলো আমি ঠিক করিনি। আমি ভুল করছি।বাবা মার সৎ আদেশ মানা যাবে কিন্তু অসৎ আদেশ মানলে উল্টো পাপ হবে।এটা ভেবেই আমি লুকিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুমি কিন্তু তা জানো যে আমি লুকিয়ে মীরার সাথে দেখা করতে গিয়েছি। জানার পরেও তোমার প্রতিশোধের আগুনে ওকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে তুমি মিথ্যে বলছো। তোমার পুত্র এবং পুত্রবধূর উপর মিথ্যে অপবাদ তুলছো!'


নাঈমের মা তখন জড়জড় করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, '


--- দেখেছো গো তোমরা দেখেছো? এই আমার কপাল। নিজের ছেলে ঘরে বউ এনেই মাকে কী রকম অপমান করছে?'


সবাই তখন হৈ চৈ শুরু করলো। তাদের মূলকথা একটাই।ছেলে বউভক্ত হয়ে গেছে।আর ওই মেয়েটি এসে নাঈমের মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আহাজারি শুরু করলো।নাঈম তখন তাকে ধমকে দিয়ে বললো,


--- 'তুই হলি বড় ডাইনি!তুই ই আম্মার কানে মন্রণা দিচ্ছিস?'


মেয়েটি মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,


--- 'আমি কোন দোষে মন্ত্রণা দিতে যাবো?'

--- 'তোকে বিয়ে করিনি এই জন্য! আমি তোকে চিনি না তুই যে কত বদ? বিয়ের আগে তুই যখন আমায় প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলি আর আমি যখন না করলাম তখন তুই এর প্রতিশোধ নিতে কী করেছিলি মনে নাই? আমার বোনের মতো বান্ধবীর সাথে আমি নোংরা কী করেছি তুই মানুষের কাছে বলে বেড়াসনি?'


মেয়েটি তখন একেবারে চুপ মেরে গেলো। কিন্তু মুখ খুললো মেয়েটির খালা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি। তিনি বললেন,


--- 'বাজে কথা বন্ধ কর।আর আমার সামনে থেকে এক্ষুনি চলে যা বলছি।'

--- নাঈম বললো,'চলে তো যাবোই। কিন্তু এখন না। যাওয়ার আগে আমি মীরার বাবা মাকে ফোন করে এখানে নিয়ে আসবো। তারপর তোমার শোধ তুমি ওদের কাছ থেকে নিবে।আর মীরাকে মুক্তি দিবে।'


নাঈমের মা ছেলের অতবড় সাহসীকতা হয়তো মেনে নিতে পারেননি।তাই তিনি নাঈমের গালে একটা চড় বসিয়ে বললেন,


--- 'আমার কথার বাইরে আরেকটা কথা বললে তোর জিহ্বা কেটে ফেলবো বেয়াদব। তুই ফোন করতে পারবি না। ফোন করবো আমি। '


বলে নাঈমের মা তার বুকের গোপন জায়গা থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন। তারপর---

'


-খোলা_জানালা

-৩য়_পর্ব (সমাপ্ত) 

অনন্য_শফিক

'

'

'

নাঈমের মা তার বুকের গোপন জায়গা থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন। তারপর বাবার ফোনে কল দিয়ে বললেন,


--- 'ছিঃ ছিঃ ছিঃ!বেয়াই সাহেব,আপনার মেয়ে তো আপনার সাথে সাথে আমারও জাত কূল ডুবাইলো!'


বাবা ও পাশ থেকে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,


--- 'কী হয়েছে বেয়াইন?কী করেছে মীরা?'


নাঈমের মা তার কন্ঠ নামিয়ে এনে বললেন,


--- 'বলতেও তো লজ্জা লাগে!কিন্তু না বললেও যে হয় না বেয়াই!আপনার মেয়ের আরেক ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে।গতকাল রাতে আমার ছেলেরে ঘুমে রাইখা সে তার ওই প্রেমিকের সাথে দেখা করার সময় আমার হাতে নাতে ধরা পড়ছে!'


নাঈমের মায়ের কথা শুনে আমার কান কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে এলো।মনে হলো মিথ্যের কোন রাজ্যে এসে আটকে গেছি আমি।বাবাও ও পাশ থেকে চুপ হয়ে গেছেন কেন জানি!হয়তোবা এমন নোংরা একটা কথা নিজ মেয়ের সম্পর্কে শুনবেন তা তিনি কল্পনাও করেননি।কিন্তু আমার বিশ্বাস বাবা মা এ কথা বিশ্বাস করবেন না কোন সময়।তারা তো আমায় চেনেন।জগতের সব মানুষ মিলে এক হয়ে আমার বৈরিতা করলেও তারা ঠিক আমার মাথার ছায়া হয়ে থাকবেন।তারা আমায় বিশ্বাস করবেন।কারণ তারা জানেন আমি কেমন!কোন প্রকৃতির!বাবার থেকে কোন সাড়া না পেয়ে নাঈমের মা এবার বললেন,


--- 'বেয়াই সাহেব আপনি ইচ্ছে করেই আমার সর্বনাশটা করেছেন।আমার নম্র ভদ্র ছেলেটার কাছে আপনার ঘরের নষ্ট জিনিসটা চালিয়ে দিয়েছেন!আমি জানি আপনাকে এসব বলে কোন লাভ নাই।কারণ আপনি শুনেও না শোনার ভান করে থাকবেন।বেয়াই,নিজে যখন শিক্ষক ছিলেন তখন তো খুব গলা বড়ো করে নৈতিক শিক্ষা দিতেন।এখন তো দেখি নিজের ঘরেই অনৈতিকতার কোম্পানি!'


কথাগুলো একদমে বলে হি হি করে হেসে উঠলেন নাঈমের মা।বাবা ও পাশ থেকে শুধু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।কিন্তু কথা বললেন‌ না।নাঈমের মা এবার বললেন,


--- 'বেয়াইনের কাছে একটু ফোনটা দেন।দুইটা কথা বলি।'


বাবা মার কাছে ফোন দিলেন।এবার নাঈমের মা মাকে বললেন,


--- 'বান্ধবী,বিরাট তো গর্ব করতা জামাই নিয়া।তোমার মাস্টার জামাই পবিত্র।তোমার সংসার পবিত্র।পবিত্র জামাইর সাথে মেলামেশা কইরা তাইলে অপবিত্র সন্তান জন্ম দিলা কেন?'


মা বোধহয় বেশ অবাক হয়েছেন।তিনি কথার প্যাঁচগোছ না বোঝে সরাসরি বললেন,


--- 'কী হয়ছে মিনা?কোন সমস্যা হয়েছে?মীরা কোন বেয়াদবি করছে?'


--- 'না না।বেয়াদবী করে নাই।শুধু বাসর রাইতে নিজের জামাইরে ঘুমের অষুধ খাইয়ে ঘুম পাতাইয়া রাইখা পুরান প্রেমিকের সাথে---'


কথাটা শেষ করতে পারলেন না নাঈমের মা।তার আগেই নাঈম তার মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে সে মাকে বললো,


--- 'শুনুন।আমার মা আপনাদের কাছে সব সত্য বলেনি।বানিয়ে বলছে।আপনারা আজকেই আসুন প্লিজ!নয়তো সমস্যা হবে আপনাদের মেয়ের!'


ও পাশ থেকে মা আর কথা বলার সময় পাননি।তার আগেই নাঈমের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিলো তার মা।তারপর ওর কলার ধরে টেনে বারান্দার বাইরে এনে উঠোনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো,


--- 'যা তুই এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।আজ থেকে তুই আমার সন্তান না।যা ভাগ।বউ নিয়া ভাগ।যাও যাও তুমিও সাথে যাও।বাইর হও আমার ঘর থাইকা।'


নাঈমের সাথে আমাকেও বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললেন তার মা।আমি বারান্দা থেকে যখন উঠোনে নেমে যেতে চাইলাম তখন নাঈম এসে আমার হাত ধরে বললো,


--- 'না।তুমি ঘর থেকে বের হবে না।আমিও বের হবো না।এই ঘরটা আমার মায়ের নয়।আমার বাবার।মৃত্যুর পর বাবার সম্পত্তিতে তার সন্তানের অধিকার বেশি।আর যে মা অসৎ তাকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনা সন্তানের কর্তব্য।আমি সেই কর্তব্য পালন করবো।আজ তোমার বাবা মা‌ এখানে আসবেন।তারপর দেখবো প্রতারক কে ছিল?তোমার বাবা যদি আমার মাকে একদিন ঠকিয়ে থাকেন এর জবাবদিহীতা তিনি এখানে করে যাবেন।আর আমার মাও তার কাছে এই জবাবদিহীতা করবেন‌ যে কোন অপরাধে তিনি তোমার উপর অত্যাচার করেছেন এবং তোমার চরিত্রে কেন কালিমা লেপেছেন!'


ছেলের মুখ থেকে এমন যৌক্তিক আর প্রতিবাদী কথা শোনে নাঈমের মা কেমন যেন ঝড়ে নিভে যাওয়া বাতির মতো দপ করে নিভে গেলেন।

'

(৫)

বাবা -মা এলেন বিকেল বেলায়। তাদের দেখে আমার কী যে কান্না পেলো! শব্দ করে কেঁদে উঠে আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।বাবা আমার পিঠে তখন আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,


--- 'তোর চেহারা এমন হয়েছে কেন? চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেমন!'


মা আমার থুতনির নিচে ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলে নাক আর কান দেখে আঁতকে উঠা গলায় বললেন,


--- 'নাক কান কাটলো কীভাবে তোর? ফুল কোথায় নাক কানের?'


আমি কিছু বলার আগেই নাঈমের মা বলে উঠলো,


--- 'তোর মেয়ের যা জেদ!আমি বললাম কী,মা, তুমি নিজের ঘরে স্বামী রেখে অন্য পুরুষের সাথে দেখা করেছো রাতে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোর মেয়ে তখন রাগে নিজের গলার চেন,কানের ফুল,হাতের চুড়ি,নাক ফুল সব টেনে টুনে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিলো!'


এই বানোয়াট কথাগুলো বলে নাঈমের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,


--- 'সব আমার কপাল।কত শখ করে বান্ধবী আর নিজের মাধ্যমিক স্কুলের স্যারের মেয়েকে ঘরের বউ করে আনলাম। কিন্তু সেই বউ---'


কথাগুলো তিনি মিথ্যে কান্নার জন্য শেষ করতে পারলেন না।একটা মানুষ কীভাবে এতো মিথ্যে কথা আর মিছে কান্নাকাটি এভাবে করতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না।

'

কিন্তু বাবা মা নাঈমের মায়ের কথায় কান দিলেন না।বাবা আমাকে বুকের উপর জড়িয়ে ধরে রেখেই বললেন,


--- 'নাঈম কোথায়?'

--- নাঈমের মা বললেন,'বাজারে গেছে।আপনারা আসবেন শুনে বাজার করতে গেছে। ছেলেটার মন এমনিতেই খারাপ।আপনারা চলে যান এখন দয়া করে।নাঈম এসে আপনাদের দেখলে তার মন আরো খারাপ হবে।'

--- বাবা বললেন,'মন খারাপ হবে কেন?সে নিজেই তো আমাদের খবর দিয়ে এনেছে।বলেছে, আমাদের সাথে আপনার কী নাকি‌ বোঝাপড়া আছে।আমরা সেই বোঝাপড়া করতে এসেছি।'


নাঈমের মা বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে মুখ কেমন কালো করে ফেললো।আর কপাল কুঁচকে এখান থেকে ভেতর ঘরের দিকে চলে গেলো।

'

নাঈম বাজার থেকে এলো সন্ধ্যা বেলায়।তার হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগ।সে এসে আমার হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বললো,


--- 'তুমি রান্না করো।আমি মা বাবার সাথে কথা বলি।'


আমি তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলাম।নাঈম ততোক্ষণে মা বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে আশে পাশের ক' বাড়ির লোক আর আত্মীয় স্বজন যারা গতরাত এসে শুনে গিয়েছিল আমার শাশুড়ির কাছে আমি দোষী তাদের ডেকে আনলো। তারপর সকলকে উঠোনে চেয়ার,পাটিতে বসতে দিলো। এবার বাবা মা আর আমার শাশুড়িকে একপাশে বসিয়ে আমায় ডাকলো।আমি এসে নাঈমের পাশে দাঁড়ালাম।নাঈম এবার বললো,


--- 'আমার মায়ের একটা পুরনো জেদ আছে আমার শশুর শাশুড়ির উপর।ছলে বলে এই পুরনো জেদের শিকারি করেছেন তিনি আমার স্ত্রীকে।এর জন্য গতরাতে তিনি মীরার উপর অত্যাচার করেছেন।তার কান,আর নাক ছিঁড়ে ফেলেছেন।সে যায়হোক। এবার আমার মা আপনাদের সামনে বলবেন কী এমন শক্ত জেদ ছিল আমার শশুর শাশুড়ির উপর যার জন্য তিনি মীরার সাথে এমন অসভ্যতামি করেছেন!আম্মা বলো!'


নাঈম তার মাকে খুলে বলতে বললো বাবার প্রতি তার কী জেদ। কিন্তু নাঈমের মা এখন কথা বলতে পারছেন না। কেমন আমতা আমতা করছেন।নাঈম এবার জোর গলায় বললো,


--- 'বলো না কেন?নাকি আমি বলবো।'


নাঈমের মা এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,


--- 'নাঈম,তুই বাড়াবাড়ি করছিস। মানুষের সামনে নিজের মাকে অপমান করছিস। তোর বউ তোকে জাদু করেছে এর জন্য তুই এমন করছিস!'


নাঈম তখন হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,


--- 'আমাকে কেউ জাদু করেনি। আমি সত্যিটা বলছি সবাই শুনুন।আর বাবা মা আপনারা আরো মনোযোগ দিয়ে শুনুন।আমার মায়ের মাধ্যমিক স্কুলের স্যার ছিলেন আমার শশুর আর আমার শাশুড়ি ছিলেন আমার মায়ের বান্ধবী।স্যারের সাথে নাকি আমার মায়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।দিন তারিখ পর্যন্ত ধার্য্য করা ছিল। কিন্তু সেই বিয়ে না‌ করে আমার শশুর আমার শাশুড়ি অর্থাৎ আম্মার বান্ধবীকে নিয়ে পালিয়ে যান।'


তারপর নাঈম খানিক সময় চুপ করে রইলো।চুপ করে থাকার পর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,


--- 'আম্মা যা বললো তা কী সত্যি?'


বাবা বেশ অবাক হলেন।আর নিজের চশমাটা খুলে দুটো চোখের জমা জল মুছলেন পাঞ্জাবির কোনো দিয়ে। তারপর ভেজা গলায় বললেন,


--- 'কী বলবো বলো বাবা? তোমার মা আমার স্টুডেন্ট ছিল। আমার স্ত্রীর বান্ধবী ছিল। তাকে আমি নিজের বোনের মতো দেখেছি সব সময়। ওদের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল আমার।ওর বাবা অর্থাৎ তোমার নানা আমায় খুব আদর সোহাগ করতেন।এতোটুকুই।এর বেশি কিছু আমি জানি না।'


বাবার পর মা মুখ খুললেন। তিনি বললেন,


--- 'মিনা, তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখতাম। বোনের মতো দেখতাম বলেই তোর ঘরে আমার মেয়েটা তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই যে এতো নীচ তা আমি জানতাম না। আচ্ছা কেন তুই এইসব মিথ্যে অভিযোগ তুলে আমার মেয়েটার উপর এমন টর্চার করলি?তার চরিত্রে কালিমা লেপলি?'


নাঈমের মা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো।নাঈম এবার তার মার কাছে গিয়ে বললো,


--- 'আম্মা, কাকে বিশ্বাস করবো/তোমাকে না উনাদের দুজনকে?না মানে তুমি তো আমার চোখের সামনেই বারবার মিথ্যে বলেছো। গতকাল থেকে মীরার উপরই শুধু একশো একটা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছো!'


নাঈমের মা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,


--- 'সবাই শুনুন।আমিই অপরাধী।আমি মীরার উপর মিথ্যা অভিযোগ তুলেছি। মিথ্যা অভিযোগ তুলেছি এই জন্য যে আমি তার বাবার কাছ থেকে ভালোবাসা পাইনি।আমি তার বাবাকে মনে মনে পছন্দ করতাম।বলতেও চেয়েছিলাম সেই কথা তার বাবার কাছে। কিন্তু বলার আগেই দেখি মীরার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে গেছে। তখন মনে মনে খুব আঘাত পাই আমি। তারপরও আশায় ছিলাম যদি উনার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়! কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো না। বিয়ের আলাপ দেয়ার আগেই মীরার মায়ের সাথে তিনি পালালেন!'


সবাই খানিক সময়ের জন্য থেমে গিয়েছিল নাঈমের মার মুখ থেকে কথাটি শুনে।নাঈম এবার তার মাকে বললো,


--- 'ছিঃ মা ছিঃ! তুমি এতো নীচ! এখানে তো আমি মীরা কিংবা তার বাবা মা কারোর দোষ খুঁজে পাইনি।সব দোষ তো তোমার। তুমি সাহস করে বলতে পারোনি। এই দোষ তো আর মীরার বাবার না। এই দোষ তোমার।এই একটা সামান্য বিষয় মনে রেখে তুমি মীরার উপর প্রতিশোধ নিয়েছো। ছিঃ মা ছিঃ!'


নাঈমের মা তখন কাঁদতে কাঁদতে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,


--- 'সবাই শুনুন।আমি অপরাধী।বড় অপরাধ করে ফেলেছি আমি।তাই আমি লজ্জিত।আপনারা কেউ এমন নিকৃষ্ট কাজ করবেন না।'


তারপর তিনি বাবা মার কাছে এসেও মাফ চাইলেন।আমার হাত ধরে বললেন,


--- 'মারে, বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি আমি।তোমার সাথে যে ব্যাবহার করেছি আমি তার জানি কোন মাফ নাই। তবুও তোমার কাছে মাফ চাইছি আমি।'


কথাগুলো বলে জড়জড় করে কেঁদে উঠলেন তিনি।আমি ভাবলাম, এখন তাকে মাফ করে দেয়া যায়।যে ভুল করে সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাকে বাঁধা দিতে নেই। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নাঈম বললো ,


--- 'যাও মীরা ঘরে যাও।ব্যাগ গোছাও।আমরা আজ রাতেই ঢাকা চলে যাবো।'


নাঈম আবার সকল সমবেত লোকেদের দিকে তাকিয়ে বললো,


--- 'আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে আপনারা দেখুন।কারোর প্রতি মিথ্যা অবিচার আর শত্রুতা পোষণ করে শেষ পর্যন্ত সফল হওয়া যায় না। বরং পরাজিতই হতে হয়!'


সবাই এক কন্ঠ হয়ে তখন বললো,


--- 'ঠিক বলেছো। তুমি ঠিকই বলেছো।'

''''''''''''

নাঈমের সাথে ঢাকায় যেতে আমি নারাজ ছিলাম। আমার শাশুড়ির জন্য আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো।আমি নাঈমকে বলেছিলাম,


--- 'শুনুন,আমরা বাড়িতেই থাকি।আম্মা তো তার ভুল বুঝতে পেরেছেনই!'


নাঈম তখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আমায় টেনে নিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,


--- 'কারোর কাছে আসার জন্য মাঝেমধ্যে এমন কিছু করতে হয়।বাহানা করে হলেও একবার দূরে যেতে হয়। দূরে যাওয়া মানেই শুধু ছেড়ে যাওয়া নয়। দূরে যাওয়া মানে আবার ফিরে আসবো এমন একটি কথা উহ্য ভাবে বলে যাওয়া।'


নাঈমের মুখ থেকে এমন একটি কথা শোনার পর আমার মনে হলো জীবনটা এতোটাও খারাপ নয়। মানুষের সুখ দুঃখ নিয়েই তো জীবন।নাঈম আমার সুখ।যেই শোক সেদিন আমার খোলা জানালা দিয়ে ঘরে এসেছিল সেই শোক আবার খোলা জানালা দিয়েই টুপ করে মিলিয়ে গেল। তারপর এলো ঘর ভর্তি সুখ।এটাই জীবন। মানুষের জীবন। জীবনের একটি অংশের গল্প।

'

                   ---সমাপ্ত---


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন এখানে ক্লিক করে।