স্বামীর সংসার

স্বামীর সংসার

কাপড়ের দোকানে একটা সুন্দর জামদানি শাড়ির দিকে চোখ আঁটকে আছে মায়ের। কয়েক মিনিট ধরে ওই এক জায়গাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। দোকানদার কাকা মায়ের কাছে প্রশ্ন করলেন,


--" আপা শাড়িটা কি বের করে দেখাবো? নতুন মাল, এইতো কালকেই দোকানে এলো। বাজারে এ শাড়ি আপনি আর কোথাও পাবেন না। একদম ফার্স্ট ক্লাস কাপড়, রংটাও বড্ড পাকা। দামটা একটু বেশি এই আর কি! 


মা মুচকি হেসে জবাব দিলেন, " না ভাই শাড়ি লাগবে না, একটু ভালো সুতির কাপড় দেখান তো। এই চার পাঁচ গজ হলেই হবে। 


মা মুচকি হেসে জবাব দিলেও মায়ের চোখের কোণে আমি স্পষ্ট পানি দেখতে পেলাম। মা সকলের চোখ আড়াল করতে পারলেও আমার চোখে মায়ের অশ্রু স্পষ্ট ধরা পড়েছে। মধ্যবিত্ত সংসারে একজন মায়ের কাছে পাঁচ-ছয় হাজার টাকার শাড়ি বিলাসিতা মাত্র! বাবা একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে, মাসে ১৫ হাজার বেতন পায় বটে তবে তা সবটাই খরচ হয়ে যায়। ছয়জনের সংসার আমাদের। তার ভিতর দাদির ঔষধ, আমাদের পড়ার খরচ, সংসারের খরচ সামলে বিলাসিতা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমরা মাঝে মাঝে ভালো কোনো কাপড় কিনলেও মা- বাবা কখনো তেমন দামী পোশাক পরতে দেখিনি। দাদিকেও আব্বু মাঝে মাঝে ভালো দামের শাড়ি কিনে দিতেন, তবে মা-কে এ বিষয় নিয়ে কখনো ঝগড়া বা তর্ক করতে দেখিনি। মায়ের কথা ছিলো, তোমার রোজগারের প্রথম হক তোমার মায়ের তাই তোমার যেমন খরচ করতে ইচ্ছে করবে তোমার মায়ের জন্য তেমন খরচ করো। আব্বু এই কথার জন্য মা'কে নিয়ে অনেক গর্ব করেন৷ তবে মা'কে যে কোনো কাপড় কিনে দেয় না এমনটা নয়। তবে সেগুলোর দাম খুব বেশি চড়া হয় না। 


( অনেকে বলবে একজন ছেলের রোজগারের প্রথম হক তার স্ত্রীর তাই সাথে রেফারেন্স দিয়ে রাখলাম। 

আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেন --" তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোন ভাল কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত। ( সূরা বাকারা, আয়াত -২১৫)

আশা করি আর কারো দ্বিমত থাকবে না)


মা সচারাচর দোকানে কোনো জিনিস কিনতে আসে না। আব্বুই সব কিনে দেয়৷ তবে কিছুদিন আব্বু অনেক ব্যস্ত থাকে সেই সকাল ৮টায় বাড়ি থেকে বের হয় আবার রাত দশটার দিকে ফিরে আসে। ওদিকে আমার যে কাপড়গুলো ঘরে পরার উপযোগী সেগুলো সুতা উঠে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে। তাই কাল রাতে আব্বু মায়ের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে বললো, " রহিমা সেদিন তুমি মিতার কাপড়ের কথা বলেছিলে না? আসলে কাজের অনেক চাপ তাই আমি কিনে আনতে সময় পাচ্ছি না।"


মা নিরবে আব্বুর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। পরেরদিন সকালে মা আর আমি বাড়ির কাছ একটা কাপড়ের দোকানে গেলাম কাপড় কিনতে, মায়ের আর আমার দুইজনের পরনেই কালো বোরকা হিজাব, মা শুধু মুখটা বের করে রাখে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় নাকি!

এসব কথা ভাবতে ভাবতে দোকানদার কাকা কাপড়ের ব্যাগটা হাতে দিলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, " আপা ৪০০টাকা দাম হেয়েছে, পাঁচ গজ কাপড়ই আছে। লাগলে পরে আবার আসবেন। 


মা হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলেন। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন, বেরিয়ে আসার সময়ও খেয়াল করলাম মায়ের চোখ ওই শাড়ির দিকে, শাড়িটার রং নীল, পাড়টা দারুণ সুন্দর। নীল রঙের জামদানি। 

মা সচারাচর রাস্তায় নিরব ভাবে চলাচল করে কিন্তু আজ হঠাৎ করে আমার কাছে প্রশ্ন করে বসলেন, " আচ্ছা মিতা একটা জামদানি শাড়ির কত দাম হতে পারে বল তো?


মায়ের পোশাকের ব্যাপার এমন আগ্রহ আমি আগে কখনো লক্ষ্য করিনি৷ কিছুটা অবাক হচ্ছি বটে, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, " আমি তো কখনো জিজ্ঞেস করিনি মা! তাছাড়া তুমি তো জানো আমি কখনো মার্কেটে আসি না৷ তাহলে কি করে বলবো বলো? তবে পাঁচ ছয় হাজার টাকার কম নয়। 


মা শাড়ির দাম শোনার পর কিছুটা দমে গেলেন। তারপর সারা পথ চুপ করে রইলেন। মা মুখে না বললেও আমি বেশ বুঝতে পেরেছি মায়ের শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে। মা তেমন বড়লোক ঘরের মেয়ে নয়। জন্মের পর পর মা মারা যায় বলে নানা মা'কে তেমন ভালোবাসেনি। মা তার নানা নানির কাছেই বড় হয়েছে। আগে আব্বুর বেতন সামান্য ছিলো তখন এতো শখ আল্লাদ পূরণ করার সামর্থ ছিলো না। বেতন বাড়ার সাথে সাথে সংসারের খরচও বেড়ে গিয়েছে। আমরা তিন ভাই বোন মা, আব্বু দাদি মিলে ছয়জনের সংসার। প্রতিমাসে দাদির প্রায় ২হাজার টাকার ঔষধ লাগে। আব্বুকে কখনো দাদির ব্যাপারে অবহেলা করতে দেখিনি। মাঝে মাঝে নিজের আব্বুকে নিয়ে অনেক গর্ব হয় যে সে একজন আদর্শ ছেলে হতে পেরেছে। 


বাড়িতে গিয়ে মা বোরকা হিজাব খুলে নিজের কাজ করতে গেলেন, যাওয়ার আগে আমার হাতে কাপড়ের ব্যাগটা দিয়ে বললেন, " কারিমা কাকির বাড়িতে বানাতে দিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি আসবি।


কারিমা কাকি আমাদের গ্রামে কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে। আমাদের বাড়ির থেকে বেশ কাছে বলে উনাকে দিয়েই আমরা কাপড় তৈরি করি। কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে কাকির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে একটা বুদ্ধি মাথায় আসলো, যদি আমি ওই জামদানি শাড়িটা কিনে মা-কে উপহার দি তাহলে কেমন হয়! কিন্তু আগে তো জানতে হবে কতটাকা দাম। আর এতো টাকাই বা কোথায় পাবো, তবে মা কখনো নিজের জন্য চিন্তা করে না, এই সামান্য কাজ টুকু আমি মায়ের জন্য অবশ্যই করতে পারবো। কারিমা কাকির কাছে কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে ছুট লাগালাম ওই কাপড়ের দোকানে। পাছে কেউ যদি কিনে নিয়ে যায়। 


কাপড়ের দোকানদার কাকা আমাকে হাঁপাতে দেখে প্রশ্ন করলেন, কি রে কিছু ফেলে গিয়েছিলে নাকি? 


আমি মুচকি হেসে বললাম, না কাকা কিছু ফেলে যাইনি৷ তবে ওই নীল জামদানির দামটা শুনতে এসেছি। কতটাকা হতে পারে ওইটার?


--" এ মাল নতুন পাঁচ হাজারের কমে হবে না। তুমি নিলে না হয় শ-পাচেক কম রাখবো। 


দাম শুনে আমার মুখটা কিছুটা মলিন হয়ে গেলো। এতো টাকা আমার কাছে নেই, আর জোগাড় করতেও সময় লাগবে, এর ভিতর যদি শাড়িটি বিক্রি করে দেয় তাহলে? দুইহাত একত্রে মিশিয়ে এসব চিন্তা করছিলাম। এমন সময় দোকানি কাকা বললেন, কি রে শাড়িটা নিবি না?


আমি ওনাকে অনুরোধের সুরে বললাম, কাকা আমার কাছে এখন এতো টাকা নেই, আপনি যদি কিছুদিন সময় দিতেন তাহলে আমি-ই শাড়িটা নিতাম। 


দোকানদার কাকা কিছু সময় ভেবে বললেন, " মা- কে কিনে দিবি বুঝি?


আমি উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দিলাম। 


--" তোর মতো মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার রে মা৷ আমার মেয়েটা যেদিন আমাকে ওর টিফিনের টাকা জমিয়ে একটা শার্ট কিনে দিয়েছিলো সেদিন আমি মনে হয় পৃথিবীটাকেই পেয়ে গেছিলাম। আচ্ছা মা আচ্ছা, শাড়িটা তুই না নেওয়া পর্যন্ত কারো কাছেই বিক্রি করবো না। 


আমি উনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তারপর খুশি মনে বাড়িতে ফিরে এলাম। এতো সহজে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবো কখনো ভাবিনি আমি। 

আমার আসতে অনপকটা দেরি হয়ে গেলো। মা আমাকে বেশ রাগী গলায় বললেন, " এতো সময় লাগে নাকি তোর? যা এখন তারাতাড়ি গিয়ে গোসল করে নামাজ পড়ে খাবার খেতে আয়৷ অনেক বেলা হলো। 

মায়ের কথা মতো গোসল৷ সেরে নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে নিলাম। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। তবে টাকার চিন্তা তো থেকেই যায়৷ রাতের বেলা সকলে খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আমাদের তিন ভাই বোনের একটা আড্ডা হয়৷ এটা দৈনিক রুটিন আমাদের, ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়, তারপর একবোন আর সবার ছোট ভাই। ভাই এবার সবেমাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। 


সকলের আড্ডার মাঝে আমি মা'কে শাড়ি কিনে দেওয়ার ব্যাপারটা জানালাম। ওরা তো শুনেই লাফিয়ে চিৎকার করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে ওদের মুখ চেপে ধরলাম। তারপর ইশারায় চুপ করতে বললাম। আমার ছোট বোনের নাম রিতা আর ভাইয়ের নাম সজিব। আমি যে খুব বড় এমনটাও নয়। কেবল মাত্র ক্লাস টেনে পড়ি। সকলে বলে বয়স অপেক্ষা আমার নাকি বুদ্ধি পেকে গেছে। আমি ওদের দুইজনকে ইশারায় চুপ করতে বলায় ওরাও ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে চুপ বলছে। 


রিতা বেশ কৌতুহলি হয়ে প্রশ্ন করলো, আপু জামদানি নাকি অনেক দামী শাড়ি? ওইদিন পাশের কাকি বলছিলো তো। তুই এতো টাকা কোথায় পাবি?


রিতার কথায় চিন্তাটা বেড়ে গেলো। সত্যি তো এতো টাকা যোগাড় করা তো সহজ ব্যাপার হবে না! অনেকদিন ধরে আমি একটা মাটির আমের ভিতর টাকা জমিয়ে আসছি। সে-ই মাটির আমটা নিয়ে আসলাম। আমার সাথে সাথে রিতা আর সজিবও ওদের ব্যাংকটা নিয়ে আসলো। তিনভাই বোন মিলে তিনজনের ব্যাংকগুলো ভেঙে টাকা গুছিয়ে গুনতে শুরু করলাম। এই পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য হয়তো আর নেই। তিন সন্তান মিলে মা'য়ের পছন্দের শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য নিজেদের অনেকদিন ধরে অল্প অল্প করে জমানো টাকা গুনছে। তিনজন মিলে খুচরা টাকা গুনে প্রায় রাত শেষের পথে চলে আসলো। এক দুই টাকার কয়েন আর কয়েকটা কাগজের টাকা গুনে টাকার অংকটা দাঁড়ালো তিন হাজার টাকা। আমরা যে এতো টাকা জোগাড় করতে পারবে ভাবতে পারিনি। কিন্তু এখনো প্রায় ১৫০০ টাকার মতো প্রয়োজন। এই টাকাগুলো কোথা থেকে জোগাড় করবো? কিন্তু মা'কে ওই শাড়িটা ইনশাআল্লাহ কিনে দিবো। 


চলবে

_জামদানির_রং_নীল

পর্ব : ০১

কলমে - ফারহানা_কবীর_মানাল


_জামদানির_রং_নীল (পর্ব : ০২)

ফারহানা_কবীর_মানাল


সকালে চিৎকারের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। আমার দাদি বেশ জোরে জোরে ঝগড়া করছে, দাদির কথাগুলো স্পষ্ট কানে এলো, 


--" সারাদিন আমার ছেলেটা কাজ করে মরে, আর জমিদারের মেয়ের জামদানি শাড়ি পরার শখ হয়? জীবনে কয়খানা জামদানি কিনে পরেছো বলতে পারো?


আল্লাহ! আবার কি হলো? মা কি আব্বুকে ওই শাড়ি কিনে দিতে বলেছে নাকি? আমি যতদূর জানি মা বরাবরই নিজের শখ আল্লাদ নিজের ভিতর রেখে দেয়। আব্বু কখনো কোনো কাপড় শাড়ি এনে দিলে একবারও বলে না যে পছন্দ হয়নি বা কিছু! তাহলে দাদি কেন মা'কে জামদানি শাড়ি নিয়ে কথা শোনাচ্ছে? তড়িঘড়ি করে মা'য়ের কাছে দৌড় লাগালাম। মা তখন চুলার উপরে বসানো হাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে আর পাশে বসে দাদি মা'কে ইচ্ছে মতো কথা শোনাচ্ছে। আমাকে দেখে মা ব্যস্ত হয়ে বললো, "কি রে এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠলি কেন? শরীর ঠিক আছে তোর? "


আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, " হ্যা মা শরীর ঠিক আছে, একটু রাত জেগে ছিলাম তাই উঠতে দেরি হয়ে গেলো। 


দাদি আমাকে দেখে কিছুটা চুপ হয়ে আছে। আমি মায়ের কাছে প্রশ্ন করলাম, " মা এতো চিৎকার শুনলাম যে, কি হয়েছে?


মা চোখের কোণের পানিটা লুকিয়ে বললেন, "না রে মা কিছু না। তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় তো। আমি খাবার দিচ্ছি। কত বেলা হয়ে গেলো এখনও পেটে কিছু না পড়লে শরীর খারাপ হবে। 


মা'র কথা ঘোরানো দেখে দাদি বলে উঠলো, " মেয়ের সামনে ভালো সাজতে হবে না বউমা! ওকেও বলো তুমি কি বলেছিলে। 


মায়ের ব্যাপারে কেউ কিছু বললে আমার একদম সহ্য হয় না৷ তাই কড়া গলায় বললাম, " কেন কি করেছে আমার মা? যে সকাল সকাল মায়ের সাথে গাল মন্দ করছেন।


দাদি এমন প্রশ্নে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললো, " তোর মা আমাকে বলছিলো কোন দোকানে নাকি একটা নীল জামদানি দেখেছে, শাড়িটা অনেক সুন্দর আরো কত কি! আমার ছেলেটা একা রোজকার করে এতো বড় সংসার চালায়, এখন উনার শাড়ি কেনার শখ হয়েছে।


দাদি কথাগুলো মুখ বেঁকিয়ে বললেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের কোণে মুছতে ব্যস্ত হয়ে আছে আর লজ্জায় মাথাটা নিচু করে আছে। এই দৃশ্যটা আমার কলিজায় গিয়ে লাগছে। কেন কেউ আমার মা'কে নিয়ে এমন কথা বলবে? দাদির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললাম " আপনি কি কখনো আমার মা'কে নিজের জন্য কিছু কিনতে দেখেছেন? আপনার ছেলে তো আপনাকে যথেষ্ট শাড়ি কিনে দেয় কখনো কি শুনেছেন যে আমার মা এই নিয়ে কোনো কথা বলেছে? মা'কে আলাদা করে আপনার ছেলে কি কিছু কিনে দেয়? একটা জামদানি শাড়ি দেখাতে পারবেন আমার মা'য়ের ঘরে? 

আপনারা শাশুড়িরা এমন কেন হন বলতে পারেন? মায়ের হয়তো শাড়িটা পছন্দ হয়েছে তাই আপনাকে বলেছে, এর জন্য আপনি এতো কথা শোনাবেন মা'কে? বউদের কোনো শখ আল্লাদের কথা শুনলে কি গায়ে জ্বালা ধরে? আবার আশা করেন বউরা আপনাদের এতো সেবা করবে মেয়ের মতো হয়ে থাকবে। কেন বউরা কি আপনাদের কেনা গোলাম নাকি? কোন মা'কে দেখছেন মেয়ে কোনো জিনিস পছন্দ বললে এমন ব্যবহার করে? আগের নিজের জায়গা থেকে বউদের মেয়ে ভাবতে শিখবেন তারপর বউদের থেকে কিছু আশা করবেন। 


এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলে চুপ করলাম। দাদি বিস্ফোরিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা-ও কিছুটা অবাক হয়ে গেছে। দাদি আমার কথা শেষ হলে কিছু সময় চুপ করে থাকলো। তারপর দাঁত কড়মড় করে বললো, তোর খুব চোপা হয়েছে মিতা। আজ তোর বাপ আসুক বাড়ি তারপর মজা দেখাবো।


কথাগুলো বলে দাদি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মা আমার কাছে এসে হাত ধরে বললো, মা কেন শুধু শুধু উনার সাথে ঝামেলা করতে গেলি? আমারই উচিত হয়নি....


মায়ের ঠোটের উপর হাত দিয়ে মা'কে বাকি কথাগুলো বলতে দিলাম না। মায়ের চোখের কোণে লেপ্টে থাকা পানিগুলো আঙুল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বললাম, "আমার মা'কে কেউ কোনো প্রকার কথা বলুক এটা আমি পছন্দ করি না। আব্বুকে বললে বলুক আমি বুঝবো। এতোটা ভালো হওয়াও ভালো নয় মা। 


মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কাল রাতে গুছিয়ে রাখা টাকাগুলো আজ জমা দিয়ে আসবো। দোকানদার কাকাই বা কোন ভরসায় শাড়িটা রেখে দিবেন। কিছু টাকা দিলে হয়তো কিছুটা ভরসা পাবেন। হাত মুখ ধূয়ে সাকলের খাবার খেয়ে বোরকা পরে হিজাবটা বেধে নিলাম। কোনো মুসলিম মেয়ের শরীর দেখিয়ে রাস্তায় চলা উচিত নয়। প্রতিটি মেয়ের জন্যই পর্দা করা ফরজ। অনেকে বলে বোরকা হিজাব পরলেই কেউ ভালো হয়ে যায় না। হ্যা বোকরা হিজাব পরলেই কেউ ভালো হয় না।কিন্তু যারা শরীর দেখিয়ে চলে তারা কি খুব ভালো হয়? পর্দা করা ইসলামের ফরজ বিধান। কেউ নিজের সৌন্দর্য অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে না চেয়ে আল্লাহ হুকুম মেনে পর্দা করে তারাই সফল। আর যারা লোক দেখিয়ে বোরকা হিজাব পরে তাদের পর্দায় কোনো লাভ হয় না। বা যারা শরীর দেখিয়ে নিজেদের ভালো দাবী করে তাদের কথা আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আখেরাতে ভালো কিছু পাওয়ার আশায় যদি দুনিয়ায় একটু কষ্ট হয় তাহলে কেন আমরা এই কষ্ট করতে রাজি হবো না? তুমি তো নিজেকে মুসলিম দাবী করো, নিজের পরিচয়ে ধর্মের জায়গাতে মুসলিম লাগাও, তাহলে কেন তোমার ধর্মের নিময় পালনে এতো অনিহা? লোকের কথা ভাবছো? এরা তো সেই লোক যারা সেদিন তোমাকে কোনো সাহায্য করবে না যেদিন তুমি বিপদে পড়বে।


টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে মায়ের কাছে বলে বাড়ি থেকে বের হলাম। মা'কে অবশ্য বলেছি কারিমা কাকির কাছে যাবো। মিথ্যা কথা বলিনি, আসার সময় ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো জামাগুলো পরার অনুপযোগী হয়ে গেছে একদম। 


দ্রুত পায়ে হেঁটে দোকানে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে দোকানি কাকা হেসে বললো, এতো তারাতাড়ি টাকার জোগাড় করে ফেললি মা?


আমি মুচকি হেসে বললাম, না কাকা সবটা জোগাড় হয়নি তবে তিন হাজারের মতো হয়েছে, এটা আপনি রেখে দেন। সব টাকা দিয়ে পরে শাড়িটা নিয়ে যাবো। 


কাকা টাকার ব্যাগটা হাতে নিলেন। কিন্তু খুচরা টাকা দেখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, এতে খুচরা বাজারে চলে না রে মা। কেউ নিতে চায় না। এখন তো এক দুই টাকার কয়েন কেউ নিতে চায় না বললেই চলে, দুই একজন দশ বিশ টাকা নিলেও তিন হাজার খুচরা কেউ নিবে না। তুই বরং আমাকে নোটগুলো দিয়ে যা, এতো কয়েন আমি রাখতে পারবো না। 


কাকা নোটগুলো গুনে দেখলেন সেখনে চারশো টাকার মতো আছে। উনি ওই টাকাগুলো রেখে কয়েনের থলিটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিলেন। আর বললেন উনি শাড়িটা রেখে দিবেন মাস খানেক। এর ভিতর টাকা দিয়ে নিয়ে যেতে। না হলে বিক্রি করে দিবেন। 


উনার কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি এখন কাগজের টাকা কোথায় পাবো? অনেক বছর ধরে এক দুইটাকা করে আমরা তিনজন টাকা জমিয়েছি, এখন কয়েন গুলো না নিলে কি হবে! আশেপাশের কয়কটা দেকানে দেখালাম, কেউ কয়েন নিতে রাজি হলো না। মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না দেশে তো কয়েন চালু আছে তাহলে লোকজন কেন কয়েন নিতে চাইবে না। পাঁচ টাকার কয়েনটা নিলেও এক দুইটাকার কয়েনে কেউ হাতও লাগাতে চায় না। বাড়ি আসার পথে কারিমা কাকির বাড়িতে উঁকি দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। আমার মন খারাপ দেখে মা প্রশ্ন করলেন, " কিরে মিতা তোর মুখটা অমন কালো কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? কিরে মা আমাকে তো বল। কিছু খেতে মন চেয়েছে তোর? তুই তো আবার বাইরের খাবার পছন্দ করিস, কাল তোর আব্বু আমার কোমরের ব্যাথার ঔষধ কিনতে চল্লিশ টাকা দিয়েছিলো ওইটা বিছানার নিচে রাখা আছে ওই দিয়ে কিনে নিয়ে আয়, মন খারাপ করিস না। 


মায়ের মুখে এমন দরদ মাখা কথা শুনে আমি মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। মা আমার শখের জন্য নিজের ঔষধ কেনার টাকাও দিয়ে দেয় আর আমি মা'কে একটা সামান্য শাড়ি কিনে দিতে পারছি না। আমার কান্না দেখে মা আরো বিচলিত হয়ে গেলেন। বারবার প্রশ্ন করতে লাগলেন কি হয়েছে, কিছু বলার না পেয়ে বললাম যে, " দাদি তেমাকে অতো কথা শোনালেন আমার খুব খারাপ লেগেছে মা? 

এই কথাটা যে মিথ্যা এমন নয় তবে আমি কাঁদছি তে অন্য কারণে।


মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, " তোর আব্বুর কষ্ট হয় টাকা রোজগার করতে তাই হয়তো বলেছে তাছাড়া তোর আব্বুর নিজেরও একটা ভালো কাপড় নেই, এর ভিতর অতো দামি শাড়ির কথা শুনে তোর দাদি রেগে গেছে হয়তো। তুই মন খারাপ করিস না। হাত মুখ ধূয়ে এদিকে আয় দেখি, একটা কাঁচা আম আছে কেটে দিচ্ছি লবণ মরিচ দয়ে খাবি আয়৷ 


আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ঘরে চলে আসলাম। কিন্তু এখন কি করে শাড়ির টাকা জোগাড় করবো? ওরা স্কুল থেকে আসলে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। 


-জামদানির_রং_নীল (পর্ব : ০৩ |শেষ প পর্ব

ফারহানা_কবীর_মানাল 


রাতের বেলা আব্বু বাড়িতে আসলেই দাদি আব্বুরর কাছে নালিশ দিলো, আমি আর মা নাকি তাকে উল্টো পাল্টা বলেছি। আব্বু বেশ রেগে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, " মিতা তোমার সাহস কি করে হয় মা'কে এইভাবে কথা বলার?


আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, " আপনার মা'কে কিছু সত্যি বললে আপনার খুব খারাপ লাগছে তাই না আব্বু? তাহলে বিনা কারণে আমার মা'কে কথা শোনালে আমি কেন ছেড়ে দিবো তাকে? 


আব্বু বিস্মিত হয়ে গেলেন। মেয়ের এমন রূপ তিনি আগে দেখেননি কখনো। দাদি বেশ আফসোস করে বলে উঠলো, দেখ বাবা দেখ কি মানুষ করেছিস নিজের মেয়েকে! একটা সামান্য কথা নিয়ে তোর মুখের উপর প্রশ্ন করে!


আব্বু এতো সময় পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। এতোদিন ধরে পরিচিত মানুষের চেহারা চিনতে ভুল হওয়ার কথা না৷ কিছু সময় চুপ করে থাকার পরে দাদির কাছে হাত জোড় করে বললেন, " মা হাজার লোকের চেয়ে আল্লাহ আমার সংসারে রহমত বেশি রেখেছেন। দয়া করে চলিত বউ - শাশুড়ি নিয়ম মানতে গিয়ে সংসারে আগুন লাগিও না। মিতার মা কখনো কোনো জিনিস নিজের জন্য কেনে বলে কি তুমি আজও দেখেছো? তোমাকে বললে যেমন আমি তোমার হয়ে প্রতিবাদ করি, মিতাও তেমনি মা'য়ের জন্য কথা বলেছে, এখানে দোষের কিছু নেই।


দাদি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু এইবার আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন, " আমি যেন আর কখনো এমন কথা না শুনতে পাই। 


আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। এখন কিছু বললে আব্বু সাথে বেয়াদবি করা হয়ে যাবে। রাতে খাবার সময় খেয়াল করলাম মায়ের মুখে আষাঢ়ের কালো মেঘ জমে আছে। খাওয়া শেষ করে ঘরে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মায়ের হাত ধরে বললাম, "আমার মায়ের মুখে হাসিটাই মানায়৷ 


মা আমার কথায় মুচকি হাসলেন। তারপর ঘুমাতে চলে গেলেন। নিজের রুমে এসে রিতা আর সজীবের সাথে টাকার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে বসলাম। কয়েন গুলো নিয়ে সজীব একটা দারুণ কথা বললো। 


--" আপু আমরা যদি এই টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংকে জমা দিতে পারি তাহলে ওরা নিশ্চয়ই আমাদের কাগজের টাকা দিবে। 


সজীবের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে ব্যাংক বেশ দূরে, আমার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব না। তাই তিন ভাইবোন মিলে যাবো ঠিক করলাম। মনের অজান্তেই কুরআনে একটা আয়াত মনে আসলো, আল্লাহ সাহায্য নিকটে, আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেন 


--"নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মত কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথি মুমিনগণ বলছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য (আসবে)’? জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী। ( সূরা বাকারা, আয়াত ২১৪)


সকালে উঠে যার যার রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। কেউ তেমন কিছু জানতে চায়নি কারণ এই সময় আমরা তিনজন স্কুলের জন্য বের হই। গায়ের পথ পাড়ি দিয়ে তারপর বড় রাস্তায় অটো ধরে স্কুলে যেতে হয়। তাও আবার আসা-যাওয়ায় বিশ টাকা ভাড়া লাগে। রোজ তিন ভাইবোনকে মোট ষাট টাকা দেওয়া লাগে আব্বুর। আব্বু এতে না করেনি কখনো। সবসময় বলেছে, আমি চাই আমার ছেলে মেয়েগুলো মানুষের মতো মানুষ হোক। 

আজ তিনজন স্কুলে না গিয়ে সোজা ব্যাংকে চলে এলাম। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় টাকা বদলে দেওয়া হয়, একটা আপু আমাদের সব কথা শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়ে কয়েন বদলে নোট করে দিলো। ব্যাংকের ম্যানেজার সজীবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, " তোদের মতো ছেলে মেয়ে যেন সব মা বাবা পায় রে, আল্লাহ তোদের মা বাবাকে অনেক নেক সন্তান দান করেছে। 

উনি আমাদের বাকি টাকাগুলো দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরা উনার কাছ থেকে টাকা আনিনি। বরং এটা বলেছি যে, " আংকেল আমার মায়ের শাড়ি আমরা টাকা জমিয়ে কিনে নিবো আপনি বরং এই টাকা কোনো পথশিশুদের দিয়ে দিবেন। 

আমাদের শেষ কথাগুলো শুনে উনি নিজের কান্না ধরে রাখতে পারেনি৷ সজীব উনার চোখ মুছিয়ে দিলো। তারপর আমরা ব্যাংক থেকে বের হয়ে ওই দোকানে গিয়ে টাকাগুলো দিয়ে আসলাম। 


এভাবে দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেছে। আজ প্রথমবার তিন ভাইবোন মিলে মার্কেট করতে এসেছি। মায়ের পছন্দ করা সেই শাড়িটা নিলাম। মনের মধ্যে যে কি ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। আব্বুর জন্য একটা শার্ট নিলাম আর দাদির জন্য এক জোড়া কাঁচের চুরি আর একটা গোলাপ। 

কি ভাবছেন? এতো কিছু কেনার টাকা কোথায় পেলাম! সেদিনের পর রোজ আমরা তিন ভাইবোন স্কুলে আসা-যাওয়ার পথ সম্পূর্ণ হেঁটে গিয়েছি৷ এইভাবে মাস শেষে ১৮০০ টাকা জমে ছিলো, অন্য দিকে একটা ছোট বাচ্চাকে পড়িয়েছিলাম। মাসে উনারা ৫০০ টাকা দিয়েছেন৷ এই দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু কেনা হয়ে গেছে।


জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। এখন সব জিনিস লুকিয়ে রাখবো তারপর রাতের বেলা সবাইকে একসাথে দিবো। আমাদের স্কুল ব্যাগের ভিতর জিনিসগুলো রেখে দিলাম। 

উফফ আজ কেন যে সময় যাচ্ছে না বুঝতে পারছি না। অপেক্ষার প্রহর সত্যি অনেক দীর্ঘ হয়। 


অবশেষে পূর্ব আকাশে উদিত সূর্য পশ্চিম আকাশে গিয়ে ডুবে গেলো। রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা তিনজন জিনিসগুলো নিয়ে সকলের কাছে গেলাম। মা তখন থালাবাসন গুছিয়ে রাখছে। মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, " মা কাজ শেষ করে এদিকে আসো তো। 


মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলেন। বাবা তখন খবরের কাগজে চোখ বুলাতে ব্যস্ত। সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়ে আর আমার আব্বু রাতে পড়ে, কাজের কারণে সকালে সময় পায় না। দাদি পান চিবুচ্ছে বসে বসে। এই মা-ও না, সারাদিনের কাজ উনার এখন করা লাগছে উনার হুহ। আমার আর তর সইছে না। কখন যে মায়ের হাতে শাড়িটা দিবো, আর মায়ের হাসি দেখতে পাবো। সব কাজ শেষ করে অবশেষে মা আসলো। আমি মায়ের হাতে কাপড়ের ব্যাগটা হাতে দিলাম। মা মনে করেছে আমার জামা বানিয়ে এনেছি তাই স্বাভাবিক ভাবে বললো, কারিমা ভাবি এতো দেরি করে তোর কাপড় দিলো?


আমি মা-র কথায় মুচকি হেসে বললাম, হুম তুমি খুলে দেখো।


মা ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতেই আমরা তিন ভাইবোন বলে উঠলাম, এইটা আমাদের মায়ের। মা কোনো কথা বলতে পারছে না৷ শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আব্বু আর দাদিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পর মা স্বাভাবিক হয়ে জানতে চাইলো টাকা কোথায় পেলাম। সবটা খুলে বললাম মা'কে। মা অনবরত কেঁদেই চলছে। আমি মা'কে জড়িয়ে ধরে রইলাম। কতটা খুশি হলে একটা মানুষ এইভাবে কাঁদতে পারে! 

রিতা এগিয়ে গিয়ে আব্বুর হাতে আব্বুর জন্য কেনা উপহারটা দিলো। আব্বুও অনেক খুশি হলো। এসব দেখে দাদি মুখ গোমড়া করে বসে আছে। হয়তো তাকে কিছু দেওয়া হয়নি তাই। সজিব দাদির জন্য আনা চুরি আর গোলাপ দাদিকে দিলো। জিনিসগুলো প্যাকেট করা, ওইগুলো দেখার পর দাদি বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো। বুঝি না আমি, এতো সুন্দর সুন্দর উপহার দিলাম আর এরা শুধু চোখের পানি ফেলছে! 


আব্বা আমাদের মাথা হাত রেখে বললো, আমার সেই ছোট ছেলেমেয়েরা কত বড় হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি। মা তখন থেকে কাঁদছে আর শাড়িটা উল্টে পাল্টে দেখছে। 

ঘরে পিনপতন নীরবতা পালন করা হচ্ছে মনে হয়! হঠাৎ নীরবতা ভেঙে দাদি বলে উঠলো, " ভাই রে, তোর দাদ মরে যাওয়ার পর কেউ আর এসব কিনে দেয়নি। আজ অনেকদিন পর তুই দিলি, আমার এই চুরি আর গেলাপ খুব পছন্দের! আমি রাগ করলে তোর দাদ এসব দিয়ে আমার রাগ ভাঙাতো। সবকিছু মনে পড়ে গেলো আজ! 


সজীব গোমড়া মুখ করে বললো, " হুহ তুমি তোমার বরের কথাই মনে করো বসে বসে, আমি যে দিলাম। আমাকে একটু ধন্যবাদ ও তো দিতে পারো নাকি? 


দাদি সজীবকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু এঁকে দিলো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, " খুব ভালো সন্তান জন্ম দিয়েছো তুমি মা! 


মায়ের চোখে তখনও আনন্দ অশ্রু লেগে আছে। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, " যাও একটু শাড়িটা পরে আসো তো দেখি বাপু! 


মা প্রথমে না না করলেও আমরা সকলে মিলে জোর করে আমাকে শাড়িটা পরে আসতে বললাম। কিছু সময় পর মা শাড়িটা পরে এলো। আমিও চোখের কোনো এক কোণে অশ্রুর স্পর্শ পাচ্ছি। মা'কে যে শেষ পর্যন্ত শাড়িটা দিতে পেরেছি এটাই অনেক। কতবার মনে হয়েছে যে পারবো না শাড়িটা কিনতে কিন্তু আল্লাহ বারবার রহমত করছে। 

মাকে আজ অপরূপ সুন্দরী লাগছে। নিজের পছন্দের জিনিসগুলোতে সত্যি সবাইকে অপরূপ সুন্দরী লাগে। মা শাড়িটা পরে আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বুও আমাদের লুকিয়ে বারবার মা'য়ের দিকে দেখছে৷ বড় ভালো লাগছে আমার৷ চোখ দিয়ে হৃদয়ে এঁকে নিলাম একটা পরিবারে সুখের মুহুর্তগুলোকে। জামদানি শাড়িটা কিনে দিতে না পারলে কি এইসব দেখতে পেতাম। এই মুহুর্তের জন্য বিগত সব কষ্ট যেন ফিকে হয়ে গেছে। মায়ের গায়ের জামদানি শাড়িটা থেকে নীল আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। হয়তো প্রমাণ করছে জামদানির রংটা নীল।


----সমাপ্ত 


এমন আরও অনেক পর্বের গল্প পড়তে ক্লিক করুন।