মায়ের ভালোবাসা

মায়ের ভালোবাসা

মায়ের বয়সী একজন ভদ্র মহিলা সবসময়ই আমার কাছে সেবা নিতে আসতেন। তাঁর একাউন্টে বিদেশ থেকে টাকা জমা হতো। ব্যাংকে এসেই একাউন্টের ব্যালেন্স  চেক করাতেন। একাউন্টে টাকা জমা হলে তুলে নিতেন। 

তাঁর কথা বার্তা আচার-আচরণে উচ্চ শিক্ষিত বলে মনে হয়েছে। খুব স্মার্টলি কথা বলতেন। কিন্তু কখনো নিজে চেক লিখতেন না। সবসময় আমাকে দিয়ে লিখাতেন। সে শুধু স্বাক্ষর করত। তাঁর চেকের স্বাক্ষর দেখে অবাক হতাম খুব সুন্দর করে ইংলিশে পেচিয়ে স্বাক্ষর করতেন। 

শুরুতে ব্যালেন্স দেখে টাকার অংক জানানো ও চেক লিখে দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলাম। বাকীটা সে নিজেই ক্যাশ থেকে টাকা তুলে নিত নিজ দায়িত্বে।

আমাকে বাবা বাবা বলে সম্বোধন করতো। আমি তাকে ম্যাম বা ম্যাডাম বললে ক্ষে/পে যেতো এবং বলত এসব বিদেশি ধার করা শব্দ শুনতে আমার ভালো লাগে না কেমন যেন পর পর মনে হয়।

একদিন চেক লিখে দেয়ার পর আমাকে বলল,বাবা আমি লাইনে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না যদি টাকাটা তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতা।সেদিন থেকে আমি নিজে অথবা কোনো পিওনের মাধ্যমে তাকে বসিয়েই সেই ব্যবস্থা করে দিতাম। এখন আমাকে সে আপনি থেকে তুমি বলেই সম্বোধন করে আমারও খুব ভালো লাগে। তাঁর বাবা ডাক আরো ভালো লাগে।

অনেক সময় খুব ব্যস্ততার কারণে তাকে যদি হেল্প ডেস্কে রেফার করে বলি যে আমার একটু দেরি হবে তিনি যেতেন না। আমার জন্যই বসে থাকতেন। কেউ তাঁর কাজটি করে দিতে চাইলেও  রাজি হতেন না।

এসব থেকে তাকে আরো দ্রুত সেবা নিশ্চিত করার নিমিত্তে তাঁর একাউন্টে এসএমএস রেজিষ্ট্রেশন সহ একটি এটিএম কার্ড ধরিয়ে দিয়ে নিজে এটিএম বুথে গিয়ে কার্ডের ব্যবহার শিখিয়ে দিই। 

তাকে বলি যে,একাউন্টে টাকা জমা হলে আপনি মোবাইলে ম্যাসেজ পাবেন এবং ২৪ ঘন্টা ব্যাংকে না এসে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারবেন। 

এসবের পরও তিনি অফিসে আসলেন। আমি তখন হেসে দিয়ে বললাম এটিএম দিয়ে টাকা তুলতে পারেন নি?

সে বলল,বাবা কার্ড ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। 

কী আর করার তাকে আগের মতোই সেবা দিলাম। সে কখনো একা আসতো না।সাথে তাঁর পরিবারের কেউ না কেউ থাকতো। তারা আমার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করত অনুমান করতাম। 

হঠাৎ একদিন সে আসার পর আমার  মনের মধ্যে কেন যেন একটা কৌতূহল জাগলো। যে এত অফিসার থাকতে সে শুধু আমার কাছে আসে কেন বা তাকে এটিএম কার্ড দেয়ার পরও কেন বুথে না গিয়ে ব্যাংকে আসে! এতদিন বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকই ছিলাম এবং পেশাদার ভাবই ছিলো। 

তাকে আজ সেবা দেয়ার আগে বললাম, যেহেতু আপনি আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করেন আমি ছেলে হিসেবে একটা বিষয় জানতে পারি? 

সে বলল, কোনো সমস্যা নেই বাবা, সব বিষয়ই তোমাকে বলতে পারি, এখন কোন বিষয়টা জানতে চাও?

আমি বললাম, এত অফিসার থাকতে আপনি আমার কাছেই আসেন এবং এটিএম কার্ড করে দিলাম সেটাও ব্যাবহার করেন না,আমি নিশ্চিত আপনি শিক্ষিত তারপরও চেক লিখেন না,কেন?

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,আমিও তোমাকে এ কথা বলারই ফুরসত খুঁজছিলাম কিন্তু বাবা তোমরা এতই পেশাদার যে ব্যক্তিগত কোন কথা বলার মতো মুড তোমাদের নেই। 

আজ তাহলে বলি,আমি একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা। আমার একটি মাত্র ছেলে ও দুই মেয়ে। আমার ছেলেটা স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে চাকুরি করে। আমার একাউন্টে সেই ছেলেই টাকা পাঠায় হাত খরচের জন্য। একবার ছুটিতে দেশে এসে বিয়ে করে চলে গেছে আমার একটি নাতিও আছে। আজ অনেক বছর হয় ছেলেকে দেখিনা।তুমি বিশ্বাস করবা কিনা বাবা জানি না তোমার চেহারা হুবহু আমার সেই ছেলের মতো। আমি তোমাকে প্রথম দেখার পর এক দৃষ্টিতে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম আর আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন হা হা করে উঠেছিল। আমি অনেকটা সময় কেঁদেছি। বাবা তোমরা বুঝবানা মায়ের মনে সন্তানের জন্য কী মায়া। তোমার কথা আমার পরিবারের সবাই কে বলেছি এবং সবাইকে আমার সাথে এনে তোমাকে দেখাইছি। তুমিতো কিছুই টের পাওনি।

আমি আমার ছেলের কথা মনে পড়লে কাজ না থাকলেও তোমাকে দূর থেকে দেখে চলে যেতাম। আমি চেক লেখা,এটিএম সব কিছুই পারি কিন্তু তারপরও তোমাকে বিরক্ত করি শুধু আমার ছেলের মতো চেহারার কারণে আর কাছ থেকে তোমাকে একটু দেখার জন্য । জানি না আমার ছেলেকে আর কবে দেখতে পারব! তবে তোমাকে দেখে একটু সান্ত্বনা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই না।

আমার কোনো কিছুর অভাব নেই। তারপরও আমি কেন যেন বড় দুঃখী। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে যদি ডাল ভাত খেয়েও দিন পার করা যেতো তারপর ও ছেলেটা আমার কাছে থাকলে আমার মনে কোনো কষ্ট থাকতো না!

তাঁর চোখ ছল ছল করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অনেকটা শিশুর মতো ফুফিয়ে কাঁদছিলো।

আমি অনেকটা বা*ক-রু'দ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না চোখের কোনে জলের প্রস্রবণ। শুধু বললাম মা আমিও আজ থেকে আপনার দ্বিতীয় ছেলে। 

আমার মুখে 'মা' ডাক শুনার পর তাঁর চেহারা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। 

.

★দ্বিতীয় ছেলে★

 

বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।