অবহেলার কষ্টের গল্প

অবহেলার কষ্টের গল্প

--- "অলি, আঙ্কেলের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে রে? সেমিস্টার ফী দিয়েছিস?"


--- "আব্বুর আর ব্যবসা, এই চলছে কোনরকম। আর হ্যাঁ ফী দিলাম তো গতকাল, তোর কী খবর? তুই তোর ভার্সিটির ফী দিস নি?"


--- "দেব কাল পরশু। আব্বু এখনো টাকা পাঠায়নি। বিরক্ত লাগে বুঝছিস, এই যে টাকা নিয়ে প্রতি মাসে টানাটানি। অলি আমাকে একটা টিউশনি দিবি?"


--- "মিহু, বড়লোক একটা বয়ফ্রেন্ড রাখ। এরপর তোর সব টেনশন তার কাঁধে।"


বলেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে অলি। কী ভীষণ সুন্দর মেয়েটা, এমন টোল পড়া হাসি দেখলে সেমিস্টার ফী কেন দিল কোরবান করতে প্রস্তুত থাকবে ছেলেরা, এটাই স্বাভাবিক। 


--- "অলি, টিউশনি করাস না এখন আর? তোর হাত খরচ কিভাবে আসে?"


--- "মিহু, এত জেনে কী করবি? শোন তুই টিউশনি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দেব? কিন্তু রুমমেট একটু বুদ্ধিমান না হলে এই শহরে টিকে থাকা মুশকিল। টিউশনি করে করে জুতোর তলা ক্ষয় করে ফেলবি, টাকার মুখ দেখবি না।"


মিহু কিছু বলতে চায়, কিন্তু অলির শোনার সময় নেই, রাতুল কল দিচ্ছে, এখনি বাইরে যেতে হবে। অলির হাতে নতুন ফোন, পরনে নতুন পোশাক। অলির দিকে তাকিয়ে অলির হাবভাব মাপে মিহু। এই দামি উপহারগুলো ছেলেদের হাত থেকে বের করা মিহুর কম্ম নয়। না ও লাস্যময়ী না দেখতে অলির মতো এত সুন্দর। মিহুর সম্বল বলতে শুধু বুদ্ধি, যার জোরে এই শহরে ও টিকে থাকতে চায়। 


--- "মিহু, আমি হোস্টেল ছাড়ছি, আর শোন আমার লাইফ নিয়ে তোর এত ভাবার কিছু নেই। কেউ ডাল ভাতে সুখী হয়, আর কেউ বিরিয়ানি খোঁজে।"


--- মিহু কথা ঘোরায়, "কোথায় যাবি অলি? সবে মাত্র দুইমাস হলো তোর রুমমেট হলাম, এর মাঝেই হোস্টেল ছেড়ে দিবি?"


--- "হ্যাঁ এই মহিলা হোস্টেলটা বড্ড সেকেলে। কত ভালো ভালো ফ্ল্যাট হয়েছে এখন। রাতুল দেখেছে। কারো সাথে রুম শেয়ার করতে হবে না, পার্সোনাল বাথরুম বারান্দা সব থাকবে। ও ছয়মাসের এডভান্সও দিয়েছে এমন একটা ফ্ল্যাটের ।"


মুখে মেক-আপের ফাইনাল টাচ দিতে দিতে বলে অলি।


--- "বিয়ের আগেই একসাথে থাকবি?"


--- "নাহ্ বোকা, আমি একা থাকব, ভাড়া রাতুল দিবে। পরে মন চাইলে বিয়ে করে নেব আমরা। তুই তো জানিস না কী মুরগী রাতুল। আমি যা বলি তাই করবে।"


--- "আচ্ছা যা, আমার জন্যও রাতুলের কাছাকাছি একটা মুরগী দেখ অলি।"


--- "তারজন্য আগে নিজেকে বদলা মিহু। শিকারি হ, মুরগী নিজেই তখন শেয়ালের কাছে আসবে।"


আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বের হয়ে যায় অলি, মিহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর চলে যাওয়া দেখে। 

.

.

.

.


--- "এই মিহু, তোর রুমমেট কোথায় রে, জানিস কিছু ?"


--- "না তো। আমি তো বাড়ি গেলাম চারদিন আগে, আজ ফিরলাম। কোথায় অলি?


--- "আরে সেটা তো আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি। অলি হঠাৎ গায়েব, তিনদিন ধরে খোঁজ নেই। ওর আব্বা এসেছিলেন গতকাল। মেয়েকে ফোনে পাচ্ছিলেন না, এর মাঝে যখন হোস্টেল থেকে কল গেল আর অপেক্ষা করেননি আঙ্কেল, ঢাকা চলে এসেছেন। থানায় মিসিং কমপ্লেইনও করেছেন আঙ্কেল।"


--- "কী যা তা বলিস। আমি তো এসব কিছুই জানি না। আমার আপা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বলে চারদিন আগে ইমার্জেন্সি বাড়ি যাই। জানিসই তো আমার আপা ক্যান্সারের রোগী। হোস্টেল সুপারকে বলে গিয়েছিলাম অবশ্য। ইসস আল্লাহ অলিকে ভালো রাখুন।"


পুলিশ আলাদা আলাদা করে সবার বয়ান নিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলতে এতটুকুই জানতে পেরেছে, যে অলির কিছুদিন যাবত এক বড়লোক বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। সেই ছেলে অলির পেছনে ভালোই খরচ করতো। বয়ফ্রেন্ডের নাম রাতুল, এর বেশি তথ্য মিহু দিতে পারেনি। অলির বাবা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছেন, তার মেয়েটা উচ্চাভিলাসী ছিল এটা তিনি জানেন, আর মেয়ের এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাতুল ছেলেটা কোন ক্ষতি করেনি তো! এই একটা ভয়ই ওনাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। 


মিহু যশোরের বাসে চেপে বসেছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সকালে খবর এসেছে ওর আপার অবস্থা ভালো না। রক্ত বমি করছে। আপার জন্য পাসপোর্ট করা হয়ছে, দৌড়াদৌড়ি করে মিহু আর তার ভাইও পাসপোর্ট করেছে। বাবার সাথে তারা আপাকে নিয়ে ভালো চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাবে, ওদের মা বেঁচে নেই। পুলিশের কাছে সমস্ত তথ্য জানিয়ে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি পায় মিহু। অলিকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সবার হোস্টেল ছাড়া নিষেধ ছিল। কিন্তু এমন ইমার্জেন্সিতে মানবিক দিক বিবেচনায় মিহুকে ছাড়ে তারা। বাড়ি ফিরে আর দেরি করে না মিহু, সেইদিন সন্ধ্যার বাসেই বর্ডার পার করতে গাড়িতে চেপে বসে, কেমোথেরাপির কাগজপত্র সহ চিকিৎসার সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে মিহু আর তার ভাই।


--- "ওনার কী হয়েছে?"


--- "আপা ক্যান্সারের রোগী। কেমো দেওয়ার পর শরীরে বল পায় না, ধরে ধরে চলতে হয়।"


কমবয়সী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খারাপই লাগে লোকটার, সাদা চামড়া কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, দৃষ্টি ঘোলাটে, ঠোঁট দুটো শুকনো খসখসে।


--- "আচ্ছা গাড়িতে বসেন, রোগী নিয়ে হাঁটাহাঁটি দরকার নেই।"


--- "জ্বি স্যার।"

.

.

.

.

অলিকে নিয়ে নির্বিঘ্নেই সীমান্ত পার হয় মিহু আর রাতুল। অবশ্য এ খেলায় তারা পারদর্শী।  

একটু মধ্যম মানের ছাত্রী হোস্টেলে প্রথমে ছাত্রী হিসেবেই রুম নেয় মিহু। হলের সুন্দরী উচ্চাভিলাসী মেয়েটাকে আলাদা করে ফেলে সহজেই। তারপর কৌশলে সময় নিয়ে তার বন্ধু হয়, দূর্বলতাগুলো জানা হয়ে যায়। এরপর শুধু সুযোগের অপেক্ষা। সময় মতো আলো ঝলকানো জীবনের হাতছানি নিয়ে হাজির হয় ভাই রাতুল। একদম গার্লফ্রেন্ডের কথায় উঠবস করা আদর্শ বয়ফ্রেন্ড বনে যায়। তারপর সময়ের অপেক্ষা, বিশ্বাসটা অর্জন করলেই আরও উন্নত আর আধুনিক জীবনের ডাক নিয়ে আসে, মন্ত্র মুগ্ধের মতো তখন বের হয়ে যায় শিকার। বেশিকিছু করতে হয় না, আধুনিক একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হয়, খাবারে একটু নেশাদ্রব্য মেশাতে হয়। এরপর বর্ডার পার করার আগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট মাত্রার মাদক দিয়ে যেতে হয়। 


একদম অচেতন ভাবেই পাচার হয়ে যায় অলির মতো অনেকেই, যারা নিজেদের শিকারী ভাবে, কিন্তু মিহুর কাছে এটাই শিকার। একটু বুদ্ধিমান না হলে যে এই শহরে ধনী হওয়া সহজ নয়। তাই তো বুদ্ধি আর সামান্য ইনভেস্ট করে অলির বদলে রাতারাতি পাঁচ লাখ টাকা আয় হয়ে গেল দুই ভাই বোনের। মামলা একটু ঠান্ডা হলেই নতুন শিকারের খোঁজে বেরিয়ে যাবে এই শিকারি দল।


-------------(সমাপ্তি) --------


ছোটগল্প : শিকার কিংবা শিকারি

লেখনীতে : Rukshat Jahan


মানুষের জীবনের ঘটে যাওয়া বাস্তব গল্প পড়ুন।