বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

"মায়ের মুখের ওপর রাগ করে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ইচ্ছে করছে গলায় দ'ড়ি দেই। বলেছি তো ভাত খাব না। তবুও সাধতে আসছে! রাগে চোখটা ফেটে যাচ্ছে আমার!


আজ তিনদিন হলো মাকে বলছি আমার একটা মোবাইল লাগবে। ত্রিশ হাজার টাকার আন অফিসিয়ালি একটা ফোন আসছে বাজারে। মেগা পিক্সেলও খুব ভালো। গেমিং এর জন্য ডিভাইসটা আরও বেশি আপডেট। ছবিও আসে দূর্দান্ত।


মাকে তিনদিন হলো বলে যাচ্ছি। বলে তোর বাবাকে বললে রেগে যাবে। আমি তবুও হাল ছাড়িনি। পেছনে লেগেই আছি। আজ ভাত খাওয়া বন্ধ করেছি। যতদিন মোবাইল না কিনে দেবে ভাত খাব না।


সকালে মা ডাকছে। আমি বিছানা থেকেই না উঠে বললাম ডাকছ কেন? বলে তোর বাবা ডাকছে। আমি উঠলাম না। বাবা কাজে চলে গেলেন। মা কয়েকবার খাওয়ার জন্য বাবু সোনা বলে অনুরোধ করলেও আমি খাইনি। দুপুরের পর রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে গেলাম। ফিরলাম সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে। এসে দেখি বাবা এখনও আসেনি। আমি আসার কিছু পরে বাবা আসল। 


আমি ঘর থেকেই শুনলাম মা বলছে বাবু গতরাত থেকে কিছু খায়নি। তুমি কিছু একটা করো। বাবা কিছু না বলে ওয়াশরুমে গেলেন। তারপর ফ্রেশ হয়ে ভেজা গামছাটা গায়ে জড়িয়ে আমার ঘরে এসে বললেন আয় খেতে আয় তোকে মোবাইল কিনে দেব। আমি খুশি হয়ে খেতে গেলাম বাবার সাথে। খাবার টেবিলে বাবা বললেন যে চাকরি করি তাতে কিছু সঞ্চয় করাতো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। আগামীকাল গ্রামে যাব দেখি জমিটা বন্ধক রাখতে পারি কিনা। আসা যাওয়া আর সব ম্যানেজ করতে হয়তো তিনদিন লেগে যাবে। এই তিনদিন একটু দোকানে বসতে হবে। নইলে মহাজন রাগারাগি করবে। তোর বাছেদ চাচা আছে সমস্যা হবে না। উনি তোকে সব বুঝিয়ে দেবেন। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললাম না। মাত্র তো তিনদিন! 


পরদিন সকালে দেখি মা ডাকছে সাতটায়। বললাম এতো সকালে কেন? বলে তোর বাবা দোকানে যেতে বলল না! আটটায় যেতে বলেছে। তোর বাবার কাছে নাকি চাবি আছে। আগেই যেতে হবে। মহাজন পরে আসে। তোর বাবা তোকে তাড়াতাড়ি ডাকতে বলে গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলেন।আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে অনিচ্ছা সত্তেও বের হলাম আমার বাবার কর্মস্থলে। 


গিয়ে দোকানের আট দশটা ইয়া বড় বড় তালা খুলে সেগুলো আবার ঠিক জায়গায় রেখে সার্টার খুলে দেখলাম ভেতরের সব হযবরল অবস্থা। ইতিমধ্যে বাছেদ চাচা চলে আসলেন। চাচাকে সাথে নিয়ে স্যানিটারির কিছু সুন্দর সুন্দর উপকরণ আর শো করে রাখা টাইলস গুলো একে একে সাজিয়ে ঘেমে নেয়ে কেবল ফ্যানের নিচে বসব। এর মধ্যে মহাজন এলেন। সাথে করে নিয়ে এলেন একজন কাস্টমার। বাবা মনে হয় মহাজনকে জানিয়ে দিয়েছেন এজন্য তিনি আমাকে দেখে অবাক না হয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন উনি আমার পরিচিত কিছু টাইলস আর স্যানিটারী পন্য কিনবেন। উনাকে সব কিছু দেখিয়ে নিয়ে এসো গোডাউন থেকে। 


আমি ক্লান্ত হয়েও বুঝতে না দিয়ে চাচা সহ কাস্টমারকে নিয়ে গোডাউনে গেলাম। চাচা একটা একটা করে সব বের করে আনলেন। আমি সব খুলে খুলে দেখালাম। উনি আরও ভালো দেখতে চাইলেন। বাছেদ চাচা দোকানের সেরা সেরা পন্য গুলো দেখালেন। শাওয়ার, কমোড, বেসিন,সিংক, টাইলস সব মিলিয়ে আমাদের এসব দেখাতে দুই ঘন্টা সময় লাগল। কাস্টমার সব দেখে বললেন আমি দোকানে গিয়ে কথা বলছি। আমি আর চাচা আর একজন লেবার মিলে সবকিছু আবার জায়গা মত রাখলাম। 


দোকানে এসে শুনি লোকটা নাকি বলেছে আরও কয়েক দোকান দেখি। আমার মেজাজ এত বিগড়ে গেল যে, কী আর বলব!

তুই যদি নাই নিবি তাহলে এতোক্ষণ ধরে এত কিছু দেখলি কেন!  

বাছেদ চাচা কী বুঝলেন কে জানে! বলল বাবা তুমি বসো একটু ফ্যানের নিচে। বসব বলে কেবল চেয়ারের ওখানে যাচ্ছি এমন সময় তিনজন লোক এসে হাজির। বলল পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের তিনটি ফ্লোরের জন্য স্যানিটারী এবং টাইলস নেব। বললাম আসেন বসেন। লোকটা সব লিস্ট করে এনেছে শুধু দাম ধরতে বললেন আর এমাউন্ট জানতে চাইলেন। বাছেদ চাচা বই দেখে দর বলে দিচ্ছেন আর আমি হিসাব করে মোট দাম বের করে খাতায় লিখছি। মাথা আমার হ্যাং হয়ে আসছে।  


এত হিসাব বাবা কেমনে করে! আমি হিসাবটা লিখে জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে সব মাল গুলো বের করে আনাই। ভদ্রলোকদের তিন জনের একজন লোক বললেন না না আজ শুধু হিসাব করে রাখলাম। কাজ শুরু হয়েছে এসব যখন প্রয়োজন হয় তখন নেব। আমার শুনে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। মনে হচ্ছিল বাবা প্রতিদিন এসব ঝামেলার কাজ নিরবে সব সয় কী করে ! 


এরপর মহাজন বসলেন দামের খাতা নিয়ে। নতুন কিছু পন্য এসেছে যেসবের দাম এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। ভালো মন্দ সব মিশিয়ে দামের একটা ব্যালেন্স করলাম আমি আর বাছেদ চাচা। মহাজন সব হিসাব টুকে রাখলেন।  


এসব করতে করতে দেখি তিনটা বেজে গেছে। এতক্ষণ কাজের চাপে খেয়াল ছিলনা। হঠাৎ মনে হলো পেটের ভেতর ক্ষুধাতে মেঘের মত গুড়গুড় করে ডাকছে। চাচাকে বললাম বাবা এসময় কী খেত? বাছেদ চাচা বললেন মহাজন দুপুরে খাওয়ার টাকা দেন। বললাম নিয়ে আসেন। চাচা ফিরে এসে আমাকে একশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম একশ টাকা দিয়ে কী খাব?


চাচা বললেন, এটা দিয়েই তোমার বাবা প্রতিদিন খান। আমি আর চাচা দোকান থেকে বের হয়ে একটা ভালো হোটেলে ঢুকব, চাচা হঠাৎ আমার হাতটা ধরে বললেন বাবা ওখানে সব খাবারের দাম বেশি। আমি বললাম সমস্যা নেই চাচা আমার কাছে আরও টাকা আছে। চাচা বললেন তুমি খাও বাবা আমি ঐযে পাশের হোটেলে খাই গিয়ে। বাধ্য হয়ে চাচার পেছন পেছন গিয়ে সস্তা হোটেলে বসলাম। অর্ডার করলাম রুই মাছ, ডাল, মাছ ভর্তা আর ভাজি। চাচা বললেন বাবা তুমি খাও আমি শুধু ডাল ভাজি নেব। বললাম চাচা এতো পরিশ্রম করলেন আর এতটুকু খাবেন?  


চাচা যা বললেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। চাচা বললেন, আমি তবুও খাই! আর তোমার বাবাতো প্রতিদিন ত্রিশ টাকা দিয়ে দুপুরের খাবার খায়। কোনদিন ডাল ভর্তা কোনদিন শুধু ভাজি, শাক। বললাম বাবা শুধু ত্রিশ টাকা দিয়ে খান? চাচা বললেন তোমাকে নাকি কলেজে যেতে প্রতিদিন সত্তর টাকা দিতে হয়। তাই তিনি একশ টাকার মধ্যে থেকে প্রতিদিন সত্তর টাকা আলাদা করে রেখে ত্রিশ টাকার যে খাবার হয় সেটাই খান। হঠাৎ যদি এই হোটেল বন্ধ থাকে তাহলে সেদিন তিনি পাউরুটি আর কলা খান। 


এরমধ্যেই সব খাবার চলে এসেছে। আমি শুধু চাচার জন্য এক পিস রুই মাছ, ডাল আর ভর্তা রেখে বাকিটা ফেরত দিলাম। ছেলেটা গজগজ করতে করতে সেসব ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সারাদিনের প্রচন্ড পরিশ্রম সত্ত্বেও আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ডাউল ভাত তবুও মনে হচ্ছে কী শুকনা! আমার বাবার মুখটা ভেসে উঠছে চোখের পর্দায়। আর ভিজে যাচ্ছে চোখ। আমি চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম ডালে খুব ঝাল চাচা। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। 


এরমধ্যে মহাজন চাচার নম্বরে কল দিয়ে জানাল আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মালের ট্রাক চলে এসেছে কোম্পানি থেকে। তাড়াতাড়ি আনলোড করতে হবে। শহরের মধ্যে বড় গাড়ি বেশিক্ষণ থাকলে জ্যাম বেড়ে যাবে।

আমি তড়িঘড়ি করে অর্ধেক প্লেটে রেখেই উঠে পড়লাম। চাচার মনে হয় এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে। তিনি সবগুলো ভাত পেটে চালান করে দিলেন। 


তারপর ফিরে এসে সবাই এক সাথে হাতে হাত লেগে মাল আনলোড করলাম। একদিনেই আমার হাত পিঠ কোমড় ব্যথায় টসটস করছে। এরপর সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বেচা বিক্রি করে বাসায় ফিরে খেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি। দেখি মা ডাকছে। বললাম, ডেকোনা আমি একেবারে সকালে উঠব। মা বললেন সকাল সাতটা বাজে উঠে পর। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সারারাত কোনদিক দিয়ে গেল আর রাত গিয়ে সকাল হলো একটুও টের পাইনি।


দোকানে গিয়ে দেখি আমি যাওয়ার আগেই বাছেদ চাচা সহ আরও প্রায় ত্রিশ জনের মত দাঁড়িয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই চাচা বললেন তোমার বাবা এসব লেবারকে দিয়ে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করান। আমরা দুজনেই এসবের সাথে থাকি। কনটাক্ট নিয়ে এসব লেবার দিয়ে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করাই। বুঝতেই পারছ যে বেতন পাই তা অতি সামান্য। তাই বাড়তি একটা ইনকাম সোর্স। বললাম আমাকে কী করতে হবে? বললেন আমি সব বুঝিয়ে দেব।


দ্বিতীয় দিনেও দোকানের সব করে বাড়তি আবার এতগুলো লেবারের খাওয়া, মজুরী মিটিয়ে আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেলাম। 


এভাবে তিনদিন কেটে গেল। আমি রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি বাবা আমার জন্য না খেয়ে প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার জন্য টাকা দেন। যেটুকু বেতন পান বাসা ভাড়া, লেখাপড়ার খরচ, সারা মাসের খাবার, চিকিৎসা আবার গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়স্বজন। আর এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি যা কষ্টের তা হলো এত হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও বাবা তার যোগ্য পারিশ্রমিক পান না। 


এজন্যই বলি বাবা কেন বাসায় এসে অঘোরে ঘুমান। আমি আমার বাবাকে সব সময় ব্যগডেটেট মনে করতাম। মনে হতো সবার বাবা কত ফিটফাট আর সুন্দর সুন্দর পোশাকে পরিপাটি হয়ে থাকে। আর আমার বাবার শার্ট পেছনে কুঁকড়ে যায় তবুও পরিবর্তন করেনা। পায়ের স্যান্ডেল একপাশ খয় হয়ে মাটি স্পর্শ করে তবুও ঐ স্যান্ডেলই নাকি ভালো বাবার। নতুন স্যান্ডেল পরলে পায়ে ফোসকা পড়ে যায়।

আহারে!!! 

আমার মিথ্যাবাদী বাবাকে আজ বুঝতে পারছি। আজ বুঝতে পারছি বাবারা কেন এত মিথ্যা কথা বলে। আমার বড্ড সেকেলে, ঘেমো জামা, ভাঙা আর গোমড়া মুখো বাবাকে আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব বাবাদের মধ্যে হিরো। না না হিরো না আমার বাবা সুপার হিরো। 


বাবার মুখটা ভাবছি । কিন্তু চোখ ভর্তি জলে বাবা অস্পষ্ট । বুক ফেটে কান্না আসছে আমার । বালিশে মুখ চেপে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছি। মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি বাবা এতদিন তোমাকে চিনতে পারিনি। ক্ষমা করো বাবা। 


কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুৃমিয়ে গেছি। সকালে মা ডাকছে কলেজে যাওয়ার জন্য। আমি আস্তে করে উঠে ফ্রেশ হয়ে দেখি বাবা খাবার টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বাবার পাশের টেবিলে বসে চুপচাপ খেতে বসলাম। খেতে খেতে বাবা বলছে তোর মার কাছে ত্রিশ হাজার টাকা রেখেছি। আমি আস্তে করে বললাম টাকা লাগবে না। আমি মোবাইল নেব না। বুঝলাম বাবা খাওয়া ছেড়ে অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমি প্লেট থেকে মুখটা না সরিয়েই বললাম, এত টাকা দিয়ে মোবাইল কেনার দরকার নেই। তুমি টাকাটা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আর এই মাস থেকে আমাকে আর কলেজের যাওয়ার খরচ দিতে হবে না। আমি একটা টিউশনের ব্যবস্থা করে নেব। তুমি ঐ টাকা দিয়ে দুপুরে পেট ভরে খেও।

 

বাবার দিকে তাকানোর সাহস আজ আর আমার হচ্ছে না। না না ভয়ে নয়, অপরাধ বোধে। এতদিন এই ত্যাগী মানুষটাকে চিনতে পারিনি সেই লজ্জায়। বাবা হঠাৎই রেগে গেলেন মার ওপরে। রেগে গিয়ে বললেন, কতবার বলি তরকারিতে ঝালটা কম দাও। এত ঝাল!!

চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি চলে আসছে । 


আমি মনে মনে বললাম কাঁদো বাবা। আজ শেষ কাঁদাটা কেঁদে নাও। আমি বেঁচে থাকতে আর কোনদিন তোমাকে কাঁদতে দেব না।


-উপলব্ধি

কুলছুম শেলী


বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন এখানে ক্লিক করে।